শুক্রবার ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলো-আঁধারিতে নেশা, লাউঞ্জে বসে সিসা

ডেস্ক রিপোর্ট   |   শনিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২২   |   প্রিন্ট   |   271 বার পঠিত   |   পড়ুন মিনিটে

আলো-আঁধারিতে নেশা, লাউঞ্জে বসে সিসা

বনানী- রাজধানীর বনেদি অঞ্চল। ১১ নম্বর সড়কের এইচ ব্লকের ২৫ নম্বর ভবন। লিফটে সওয়ার হয়ে ১১ তলায় পা ফেলতেই সামনে কালো দরজা। লেখা- এক্সিট রিলোডেড। ভেতরে ঢুকতেই ধোঁয়াচ্ছন্ন আলো-আঁধারির খেলা। মৃদু সুরে বাজছে গান। কেউ কেউ বসে বসে দিচ্ছেন তাল। সোফায় বসে তরুণ-তরুণীরা পাইপ টানছেন আর ধোঁয়া ছাড়ার পর উল্লাসে মাতছেন। অভিজাত এই সিসা লাউঞ্জের ওপর তলায় আরেকটি লাউঞ্জ টিজেএস। শুধু এ দুটিই নয়- বনানী, গুলশান ও ধানমন্ডি এলাকায় রয়েছে ২০টির বেশি সিসা লাউঞ্জ।

আলো-আঁধারির সিসা লাউঞ্জের মতোই আলো-আঁধারিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। সিসা লাউঞ্জ অবৈধ এবং সিসা এক ধরনের ‘মাদক’- তা খোদ ডিএনসিই বলছে। ‘খ’ শ্রেণির মাদক হিসেবে এটিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনে বলা আছে, সিসা অর্থ বিভিন্ন ধরনের ভেষজের নির্যাস সহযোগে শূন্য দশমিক ২ শতাংশের ঊর্ধ্বে নিকোটিন এবং এসেন্স কেরামেল-মিশ্রিত ফ্রুটস স্লাইস সহযোগে তৈরি যে কোনো পদার্থ। ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে এই আইন কার্যকর হলেও বাস্তবায়ন নেই সেভাবে। এমনকি ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রতিবেদনে এসব লাউঞ্জের সিসায় মাত্রাতিরিক্ত নিকোটিন মিললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। এ সুযোগে দিব্যি কারবার চালাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএনসির কাছে সিসা লাউঞ্জের তালিকা রয়েছে, অথচ চালানো হয় না অভিযান। ডিএনসির উপপরিচালক (অপারেশন) আহসানুর রহমান দাবি করেছেন, নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন তাঁরা। তিনি এই দাবি করলেও গত দুই মাসে কোনো সিসা লাউঞ্জে অভিযান চালানোর তথ্য মেলেনি। এ বিষয়ে আহসানুর রহমান বলেন, ‘কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মালিক সিসার ব্যবসা চালানোর জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। সিসায় দশমিক ২ শতাংশের বেশি নিকোটিন থাকলে আমরা অভিযান চালাতে পারব।’

অবশ্য গত বছরের ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রতিবেদনই বলছে, রাজধানীর ১৯ লাউঞ্জের সিসায় মাত্রাতিরিক্ত নিকোটিন মিলেছে, যেসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ এখনও চলছে। যেসব সিসা লাউঞ্জের নমুনা সংগ্রহ করা হয়, এর মধ্যে অন্যতম হলো বনানীর হেজ রেস্টুরেন্ট, থার্টি টু ডিগ্রি, আল গেসিনো, আরগিলা রেস্টুরেন্ট ও কিউডিএস এবং গুলশানের মনটনা লাউঞ্জ। এ ছাড়া ধানমন্ডি, উত্তরা ও খিলগাঁওয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটিতে দশমিক ২ শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া যায়। বনানীর হেজ থেকে গত এপ্রিলে এবং নভেম্বরের শুরুতে গুলশানের মনটনা লাউঞ্জ থেকে ফের নমুনা নিয়ে পরীক্ষাগারে পাঠায় ডিএনসির গুলশান সার্কেল। প্রশ্ন হলো, ডিএনসি কি শুধু নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে সিসা পরীক্ষার ফলাফলের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। তাতে লিখেছেন- সিসা সেবন ও বিক্রি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে নিষিদ্ধ। তবে থেমে নেই নিষিদ্ধ এই দ্রব্যটির কারবার। আইন অনুযায়ী সিসা সেবন, বহন, বিক্রি ও সরবরাহ করলে এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, ডিএনসির সংশ্নিষ্ট কিছু কর্মকর্তা এবং পুলিশের ছায়া রয়েছে এই মাদক কারবারে। বনানী এলাকার সিসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট এমন কয়েকজন জানিয়েছেন, প্রতি মাসে সংশ্নিষ্ট এলাকার কিছু পুলিশ ও ডিএনসির কর্মকর্তা সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পান।

এর মধ্যে ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তরের গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক নাজমুল হোসেন খান বনানী ও গুলশান এলাকার প্রতিটি সিসা লাউঞ্জ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেন। তবে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে নাজমুল হোসেন খান বলেন, ‘আমি কয়েকটি সিসা লাউঞ্জ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি।’

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানী এলাকায় ২০টির বেশি সিসা লাউঞ্জ এখনও চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রভাবশালী। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিও রয়েছে কারও কারও। সম্প্রতি গুলশান ও বনানী এলাকার অন্তত ১০টি সিসা লাউঞ্জে সরেজমিনে যান এই প্রতিবেদক। কথা হয় অন্তত ৩০ সিসা সেবনকারী তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী। প্রায় সবাই এসব সিসা লাউঞ্জের নিয়মিত গ্রাহক।

বনানীর ১২ নম্বর রোডের ই-ব্লকের ৭৭ নম্বর ভবনের ১০ তলায় আল গেসিনো নামে সিসা লাউঞ্জটি চলে দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। সরেজমিনে দেখা যায়, লিফটের ৯-এ প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। সোফায় বসে তরুণ-তরুণীরা সিসা ফুঁকছেন। এক তরুণ নাম প্রকাশ না করে বলেন, সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন তিনি বান্ধবীকে নিয়ে এখানে আসেন। তিন-চার ঘণ্টা কাটিয়ে চলে যান। ওই ভবনে অবস্থান করেন এমন একজন জানান, দুপুর থেকে খোলা থাকলেও সন্ধ্যার পর দলে দলে লোকজন আসে এখানে।

বনানীর ১১ নম্বর রোডের এইচ ব্লকের ৩৯ নম্বর ভবনের দোতলায় সিসা লাউঞ্জ থার্টি টু ডিগ্রি। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠেই দেখা যায়, গেটের সামনে এক যুবক। তাতে বোঝা গেল, বাইরে বেশ কড়া নিরাপত্তা জারি রেখেছে মালিকপক্ষ। বনানীর ডি ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ৬৬ নম্বরে আরগিলা নামে সিসা লাউঞ্জ। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে কী চলছে! আলো-আঁধারিতে চলে সিসা সেবন। সম্প্রতি রাত ৯টার দিকে ১১ নম্বর সড়কের ই ব্লকের ৬৭/ডি নম্বর ভবনের লিফটের ৬-এ হেজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, ১৫-১৬ তরুণ-তরুণী আছেন সেখানে। হাতে সিসার পাইপ। মিউজিকের তালে তালে অনেককেই নাচতে দেখা যায়। এ ছাড়া একই সড়কের সি ব্লকের ১০০ নম্বর ভবনের চারতলায় ‘লেভেল ৪ রেস্টুরেন্ট’, এফ ব্লকের এক নম্বর ভবনের লিফটের ৪-এ কিউডিএস রেস্টুরেন্টে গিয়েও সিসা বেচাকেনার দৃশ্য দেখা যায়।

ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, তামাক পাতার সঙ্গে বিভিন্ন ফ্রুটস স্লাইস, গ্লিসারিন, কেরামেল ফ্লেভার দিয়ে তৈরি করা হয় সিসা। এগুলো আগুনে পুড়লে কালো ধোঁয়া ‘টার’ উৎপন্ন হয়, যা ফুসফুসে আঘাত করে কালো লেয়ার তৈরি করে। এতে ক্যান্সার হওয়ার শঙ্কা থাকে। তিনি আরও বলেন, ইদানীং ডিএনসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যত প্রতিষ্ঠানের নমুনা পাঠিয়েছেন, এর সবক’টিতেই দশমিক ২ শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া গেছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

Facebook Comments Box

Posted ১২:৪৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২২

nykagoj.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

ক্যালেন্ডার

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
সম্পাদক
আফরোজা ইসলাম
কন্ট্রিবিঊটিং এডিটর
মনোয়ারুল ইসলাম
Contact

+1 845-392-8419

E-mail: nykagoj@gmail.com