বুধবার ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সামনে সামরিক কমান্ডার আয়মান, পেছনে জিয়া

ডেস্ক রিপোর্ট   |   মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০২২   |   প্রিন্ট   |   97 বার পঠিত   |   পড়ুন মিনিটে

সামনে সামরিক কমান্ডার আয়মান, পেছনে জিয়া

হাল সময়ে সক্রিয় সবচেয়ে বিপজ্জনক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি)। ২০১৩ সালের পর সংগঠনটি খোলে আলোচনার খাতা। একের পর এক লেখক ও ব্লগার হত্যা করে রক্তে ভেজে আনসার আল ইসলামের সদস্যদের হাত। সব শেষ গেল রোববার সংগঠনটি জানান দেয় তাদের শক্তি-সাহস। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই সহযোদ্ধা জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেলকে দিনদুপুরে পুরান ঢাকার আদালত আঙিনা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় বীরদর্পে।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আনসার আল ইসলামের বর্তমান সামরিক কমান্ডার মশিউর রহমান আয়মানের নেতৃত্বে ছিনিয়ে নেওয়া হয় এ দুই জঙ্গিকে। আয়মান সংগঠনটির বড়মাপের বোমা কারিগর। আড়ালে বসে এই ছিনতাই ছকের অঙ্ক মেলান পলাতক দুর্ধর্ষ জঙ্গি মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া। জঙ্গি তৎপরতার ওপর দীর্ঘ এক যুগের বেশি তথ্য রাখেন এমন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, বছর দুই আগে আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামোতে বড় পরিবর্তন হয়। দীর্ঘ দিন সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন জিয়া। এখন তিনি সংগঠনের আইটি শাখার প্রধান। সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন আয়মান।

জানা গেছে, আয়মানের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরের ত্রিফলতলায়। তিনি ছিলেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সহকারী পরিচালক। দীর্ঘ দিন তিনি প্রকাশ্যে নেই। ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার তিনি অভিযোগপত্রভুক্ত ১৭ নম্বর আসামি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে কখনোই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আনসার আল ইসলামের বেশ কয়েকটি অপারেশনে তাঁর নাম এসেছিল। তখন সংগঠনের সদস্য হিসেবে অভিযানে অংশ নেন তিনি। সামরিকপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর রোববারই প্রথম জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্ব দেন। তবে সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে, নাকি কোনো গোপন জায়গায় বসে জিয়ার পরিকল্পনায় আয়মান ছিনতাই অভিযানে কমান্ডারের ভূমিকা পালন করেছেন, সেটি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আয়মান সরকারি কর্ম কমিশনের ঢাকা, রংপুর ও রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। ২০২০ সালের ১২ মার্চ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিখোঁজ হন। তিনি চাকরি ছাড়ার পর বাড়িতেও যোগাযোগ করেননি। অনেক খোঁজার পর না পেয়ে মশিউরের বাবা সহিদ হোসেন কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন।

আরেকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনায় রিমান্ডে থাকা জঙ্গিরা তাদের জানিয়েছেন, চারজনকে ছিনতাইয়ের লক্ষ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে সবুর ও আরাফাতকে ছিনিয়ে নেওয়া যায়নি। তাঁরাও মৃত্যুদণ্ডের আসামি। এই ছক কষা হয় ৫-৬ মাস আগে। সার্বিক বিষয়ে সবচেয়ে ভালো জানতেন সোহেল। রোববার তাঁদের ছিনিয়ে নেওয়া হবে- নিশ্চিত হয়েই তাঁরা কেডস, ট্রাউজার পরে আদালতে আসেন। আর ১০-১২ জন ছিনতাইয়ে জড়িত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৬ জনকে সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে। অনলাইনে পাঁচ মাস আগে কেনা হয়েছিল মোটরসাইকেল। পরে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন করা হয়। এরই মধ্যে জঙ্গিদের ব্যবহূত একটি মোটরসাইকেল পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছে।

আনসার আল ইসলামের যে কয়েকটি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সামরিক, আইটি, দাওয়াতি ও লজিক্টিকস শাখা। এ ছাড়া আলাদা শূরা বোর্ডও রয়েছে। সেখানকার সদস্য ৫-৬ জন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন শাখাপ্রধানকে রদবদল করেন আমির। তাই জিয়ার বদলে আয়মানকে সামরিক শাখার প্রধান করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দানকারী ও তার সহযোগীদের নাম পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা কীভাবে হয়েছে এবং অভিযানে কারা ছিল, এসব তথ্য তদন্তে উঠে এসেছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চার জঙ্গিকেই ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল তাদের সহযোগীরা। অপর জঙ্গিদেরও আদালত থেকে নিচে নামিয়ে আনা হলে হয়তো তাদেরও ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত।

সিটিটিসির প্রধান জানান, রোববার যে আসামিদের হাজিরা দিতে আনা হয়েছিল, তারা সবাই আনসার আল ইসলামের শীর্ষ জঙ্গি। সংগঠনটির সামরিক শাখা আশকারি বিভাগের সদস্য তারা। তাদের প্রত্যেককে ২০১৬ সালে সিটিটিসি গ্রেপ্তার করেছিল। পলাতক জঙ্গিরা যাতে সীমান্ত পাড়ি দিতে না পারে সে জন্য সব পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক রয়েছে।

জঙ্গি ছিনতাই ঘটনায় রোববার রাতে কোতোয়ালি থানায় ২০ জনের নামে মামলা করে পুলিশ। মামলাটি গতকাল সিটিটিসিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।

জড়িতরা নজরদারিতে: আদালত চত্বরে পুলিশের কাছ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িতরা নজরদারিতে রয়েছে এবং যে কোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গতকাল সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ডিবিপ্রধান বলেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার মাস্টারমাইন্ড মেজর (বরখাস্ত) জিয়া। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর তাৎক্ষণিক রাজধানীর সব সড়কের চেকপোস্টসহ বিভিন্ন স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। মেজর (বরখাস্ত) জিয়ার নির্দেশেই দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আদালত চত্বর এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ আসামি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

পাঁচ পুলিশ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত: আদালত চত্বরে দায়িত্বে অবহেলায় সিএমএম আদালতের হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ এসআই নাহিদুর রহমান ভূঁইয়া, আসামিদের আদালতে নেওয়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশের এটিএসআই মহিউদ্দিন পাল, কনস্টেবল শরিফ হাসান ও আবদুস সাত্তারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় ডিএমপির ৪ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছে পুলিশ সদরদপ্তর। কমিটির প্রধান করা হয়েছে পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অডিট) আমিনুল ইসলামকে। অন্য সদস্যরা হলেন- সদরদপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি হাসানুজ্জামান, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপকমিশনার এএইচএম কামরুজ্জামান ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

আদালতপাড়ায় কড়া নিরাপত্তা: রোববার প্রকাশ্যে পুলিশের কাছ থেকে আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর আদালতপাড়ার নিরাপত্তা নিয়ে টনক নড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এ কারণে গতকাল আদালত চত্বর ও এর আশপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এমনকি দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর সহযোগীরা ঢাকা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশে যে গলি দিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়, সেই রঘুনাথ দাস লেনেও পুলিশ মোতায়েন ছিল গতকাল। সিএমএম আদালত ভবনে ঢোকার প্রধান ফটক থেকেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

সিজেএম আদালতের প্রধান ফটকের পাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য জানান, সকাল থেকে তাঁদের দায়িত্ব শুরু হয়েছে। প্রধান ফটকটি অন্য দিন খোলা থাকে। গতকাল সেটি বন্ধ রাখা হয়।

আইনজীবীরা বলছেন, একটি ঘটনা ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে। তেমনি জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর এখন আদালত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দু-চারদিন পর হয়তো আবার আগের মতোই হয়ে যাবে সবকিছু।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের (প্রসিকিউশন) উপকমিশনার জসিম উদ্দিন বলেন, গতকাল সকাল থেকে আদালত প্রাঙ্গণে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।

অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব: র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল বলেছেন, র‌্যাব আদালত প্রাঙ্গণ ও সংশ্নিষ্ট এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা কার্যক্রম চলছে। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গির আগের অপরাধের ধরন, তাদের আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন সময়ে চলাচলসহ সবকিছু পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পলাতক জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনতে র‌্যাবের সব ইউনিট অভিযান চালাচ্ছে। এদিকে জঙ্গি ছিনতাই ঘটনার পর সীমান্ত এলাকা ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

Facebook Comments Box

Posted ২:০৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০২২

nykagoj.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

ক্যালেন্ডার

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
সম্পাদক
আফরোজা ইসলাম
কন্ট্রিবিঊটিং এডিটর
মনোয়ারুল ইসলাম
Contact

+1 845-392-8419

E-mail: nykagoj@gmail.com