বৃহস্পতিবার ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খরতাপে বিশাল ঝুঁকিতে পাহাড়

সারাদেশ ডেস্ক   |   মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   55 বার পঠিত   |   পড়ুন মিনিটে

খরতাপে বিশাল ঝুঁকিতে পাহাড়

তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের মাটি অম্লীয়। এ ধরনের মাটির ওপরের অংশ পাতলা, নিচের অংশে থাকে কংকর বা ছোট ছোট পাথর ও বালু। বেলে ও দো-আঁশ শ্রেণির এই মাটি সাধারণত নরম হয়। স্মরণকালের খরতাপে এই মাটি এখন ঝুরঝুরে হয়ে আছে। টানা বৃষ্টির পানি পেলে মাটির ওপরের স্তর ধুয়ে বড় ধরনের পাহাড় ধস হতে পারে। বর্ষায় চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলার কিছু পাহাড়ে এমন ধসে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় সাড়ে ২১ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। চট্টগ্রামের ১৮ পাহাড়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে অর্ধলাখ। উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় লঘুচাপের প্রভাবে পাহাড়েও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। টানা ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের শঙ্কা বেড়ে যাবে।
টানা ভারী বৃষ্টির কারণে ২০১৭ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম, তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারে প্রাণ গেছে ১৬৮ জনের। ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকা, মুসলিমপাড়া, শিমুলতলী, রূপনগর, সাপছড়ি, মগবান, বালুখালী এলাকায় এবং জুরাছড়ি, কাপ্তাই, কাউখালী ও বিলাইছড়ি উপজেলায় পাঁচ সেনাসদস্যসহ ১২০ জনের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় প্রাণ হারান ১২ জন। এতে রাঙামাটির ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারাদেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ এক সপ্তাহ বিচ্ছিন্ন ছিল। ভয়াবহ এই পাহাড় ধসের পর পুনর্বাসন দূরের কথা, বরং পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আরও নতুন ঘরবাড়ি উঠেছে।

চট্টগ্রামে পাহাড় কাটছে সরকারি সংস্থা
ব্যক্তির পাশাপাশি চট্টগ্রামে নির্বিচারে পাহাড় কাটছে সরকারি সংস্থাও। সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলাও রয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন জহিরুল ইসলাম। তাঁর বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার একাধিক মামলা রয়েছে। লালখানবাজার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এ এফ কবির মানিক ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরনের বিরুদ্ধেও পাহাড় কাটার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ১৩টি পাহাড় কেটে বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করার অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য তাঁদের ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করে পরিবেশ অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও ওয়াসার বিরুদ্ধেও আছে পাহাড় কাটার অভিযোগ।

মিলেমিশে পাহাড়ে কোপ
প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিও কাটছেন পাহাড়। নগরীর বায়েজিদের আরেফিননগর এলাকায় পাহাড় কাটার দায়ে এক মাদ্রাসা অধ্যক্ষসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গত বছর মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে পাহাড় কাটার প্রমাণ পান। সেখানে পাহাড় কেটে বসতঘর, পানির কূপ, রাস্তাসহ নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। তা’লীমুল কোরআন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ তৈয়বের নির্দেশনায় পাহাড় কাটা হয়েছে বলে প্রমাণ পায় পরিবেশ অধিদপ্তর। অথচ পাহাড় কাটার কোনো অনুমতি ছিল না। অভিযুক্তদের শুনানির নোটিশ দেওয়া হয়। শুনানিতেও তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না।

পাহাড়ের কোলে ঝুঁকিপূর্ণ বাস
রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের ২৯ স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া নানিয়ারচর, কাউখালীসহ কয়েকটি উপজেলায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ১৫ হাজারের বেশি পরিবার বাস করছে। বান্দরবানে পাহাড়ের পাদদেশে দুই হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে। খাগড়াছড়ির প্রায় চার হাজারের ওপরে পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাস করছে।

সুপারিশ আছে কাগজে, বাস্তবে নেই
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন, অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ এবং বন-জঙ্গল ও গাছ উজাড়ের কারণেই পার্বত্য অঞ্চলে একের পর এক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। ২০১৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসের পর একাধিক মন্ত্রণালয়ের কমিটি বিভিন্ন সুপারিশ করে। এসবের মধ্যে রয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী ছিন্নমূল মানুষের জন্য স্থায়ী আবাসন নির্মাণে জায়গা নির্ধারণ, রাঙামাটিতে আশ্রয়হীন এবং যারা পাহাড়ের পাদদেশে বাস করছে, তাদের জন্য সরকারি অর্থায়নে স্থায়ীভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধ, পাহাড়ে পরিবেশবান্ধব এবং পাহাড় রক্ষাকারী বৃক্ষ ও বাঁশ রোপণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, পাহাড় থেকে মাটি কেটে ও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশ কাগজে থাকলেও এখনও দৃশ্যমান বাস্তবায়িত হয়নি। তবে প্রতিবছর বর্ষা এলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাইনবোর্ড ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে থাকে।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সুপ্রিয় চাকমা বলেন, গাছপালা ধ্বংস, নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। কারণ পাহাড়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে একটি স্তর থাকে। তবে মাটির যে স্তর আছে বেশি পাহাড় কাটা হলে তাতে পাহাড় ধসের শঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, একনাগাড়ে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের ঝুঁকি রয়েছে।
মৃত্তিকাসম্পদ ইনস্টিটিউট রাঙামাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি করা ছাড়াও পাহাড় কেটে আনারস, আদা, হুলুদ ও কচু চাষ করা হচ্ছে। এতে পাহাড়ে ভূমিধসের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

প্রশাসনও অসহায়
পাহাড় ধসের পর ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি স্থাপন করা ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের কথা বলে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। এটি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি তারা। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড় ধসে প্রতিবছর প্রাণ হারায় মানুষ। স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য আমরা কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েছি। তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।’
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যে রাঙামাটি পৌর এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র।

Facebook Comments Box

Posted ১:১১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩

nykagoj.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

ক্যালেন্ডার

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
সম্পাদক
আফরোজা ইসলাম
কন্ট্রিবিঊটিং এডিটর
মনোয়ারুল ইসলাম
Contact

+1 845-392-8419

E-mail: nykagoj@gmail.com