
আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বুধবার, ১৫ মে ২০২৪ | প্রিন্ট | 146 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, শনিবার ইহুদিদের জন্য নতুন একটি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। নাম রাখা হয় ইসরায়েল। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরদিন অর্থাৎ, ১৫ মে থেকেই স্থানীয় আরব অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে মহাবিপর্যয়, দুর্যোগ বা আল নাকবা। যদিও ইসরায়েলিরা একে বলে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’।
বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের নারী-পুরুষ ও শিশুরা।
১৫ মে থেকে ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সেনারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হত্যা-ধর্ষণ-লুট-অগ্নিসংযোগ শুরু করে। প্রাণভয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে পালাতে থাকে। উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেন পাশের দেশ জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায়। এরপর থেকেই এক অনিঃশেষ অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হন ফিলিস্তিনিরা, যা আজও চলছে। আর তাই প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস হিসেবে পালন করেন।
শুরু যেভাবে
অস্ট্রিয়ার ইহুদি সাংবাদিক, নাট্যকার ও রাজনীতিক থিয়োডর হারজেল তার ডায়েরিতে ১৮৯৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন, ‘ব্যাসেলে আমি ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করেছি। যদি আমি এটা এখন প্রকাশ্যে বলি, তাহলে আমি হয়তো দুনিয়াজুড়ে হাসির খোরাক হব। তবে সম্ভবত ৫ বছরের মধ্যে এবং নিশ্চিতভাবে ৫০ বছরের মধ্যে সবাই এটা দেখতে পাবে।’
১৮৯৭ সালের ২৭ আগস্ট সুইজ্যারল্যান্ডের ব্যাসেল নগরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইহুদিবাদী সম্মেলন (ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট কংগ্রেস)। তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনে শুধু ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা গৃহীত হয়। হারজেলই ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা। এর আগের বছর, মানে ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার লেখা পুস্তিকা ইহুদি রাষ্ট্র (দ্য জিউইশ স্টেট) প্রকাশিত হয় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে।
হারজেল ও তার সহযোগীরা মনে করতেন যে, ইহুদিবিদ্বেষ ঠেকানোর রাজনৈতিক সমাধান হলো একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক জেরুজালেম শহরের আরেক নাম জায়নকে বেছে নেওয়া হয় ইহুদিদের বিশ্বাস, আবেগ ও অনুভূতিকে সংবেদনশীল করে তোলার জন্য। ফিলিস্তিনের ভূমিকেই ঠিক করা হয় ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য। হিব্রু বাইবেলের সূত্র ধরে দাবি তোলা হয়, এটাই ইহুদিদের জন্য ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি (প্রমিজড ল্যান্ড), যেখান থেকে তারা একসময় বিতাড়িত হয়েছিল। কাজেই সেখানে ফিরে যাওয়া তাদের ন্যায্য ও বৈধ অধিকার।
এই অধিকার আদায়ের জন্য শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা। হারজেল ১৮৯৬ সালে ইস্তাম্বুলে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেরেছিলেন যে জেরুজালেমসহ অটোমান-ফিলিস্তিনের কিছু অংশ ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ দিতে। বিনিময়ে ঋণগ্রস্ত সুলতানকে এখনকার বাজারদরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার দিতেও চেয়েছিলেন। সুলতান তা প্রত্যাখ্যান করেন।
উসমানীয় সুলতানের সঙ্গে দেনদরবার ব্যর্থ হওয়ায় হারজেল ও তার সঙ্গীরা ব্রিটিশ সরকারের দিকে ঝোঁকেন। এদিকে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের খেলায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হতেই ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর ইহুদিবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনের সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। ইতিহাসে যেটি ব্যালফোর ঘোষণা হিসেবে খ্যাত। এরপর ১৯২০ সালে ইতালির সান রেমো শহরে ভেঙে পড়া উসমানীয় সাম্রাজ্য ভাগবাঁটোয়ায় ফিলিস্তিন ও ইরাক শাসনের ম্যান্ডেট পায় ব্রিটেন, যার বৈধতা দেয় লিগ অব ন্যাশনস।
প্রকৃতপক্ষে ইহুদিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে ইউরোপে জায়নবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ায় ১৮৮০ সালের দিক থেকেই ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিনে এসে বসতি গাড়তে শুরু করেন। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় ইহুদিদের স্বপ্ন বাস্তবে নেমে আসে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির থেকে বের হচ্ছেন নারীরা। ছবি: সংগৃহীত
১৯৪৭ সালে নবগঠিত জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দুই ভাগ করে দুটি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করে। আরব বিশ্ব এটি প্রত্যাখ্যান করলেও প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতা ছিল না তাদের। বরং হারজেলের পূর্বাভাস সত্যি ও ব্যালফোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনে তাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটায়, ইহুদিবাদীরা ঘোষণা দেয় স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্রের। এর পরই শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি, ইহুদি আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালাতে থাকেন। যার সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালের ১৫ মে, যা আল-নাকবা বা বিপর্যয় হিসেবে পরিচিত।
সেই নাকবার ৭৬ বছর পূর্ণ হলো আজ। এর মধ্যে তিনটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরব দেশগুলোর পরাজয় ও ব্যর্থতাই বেড়েছে। তাই ফিলিস্তিনে আজও চলছে ইসরায়েলের দখলদারি। ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড সংকুচিত হয়ে গেছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা আর জর্ডানের পশ্চিম তীরে। তাদের জীবন-জীবিকা নিত্য নিষ্পেষিত হচ্ছে ইসরায়েলের খামখেয়ালিতে। আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম উদ্বাস্তু আর শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছেন লাখো ফিলিস্তিনি।
কি হয়েছিল সেদিন?
১৯৪৮ সালের এই ১৪ মে জন্ম হয় ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের। এর পরদিন ১৫ মে থেকে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হত্যা-ধর্ষণ-লুট-অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। প্রাণভয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে পালাতে থাকে। সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় গিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেন।
১৯৪৭-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে ইহুদিরা ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৭৮ ভাগ জায়গা দখল করে নেন। ফিলিস্তিনের ৫৩০টি গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ৭০টি ছিল গণহত্যা।
এরপর থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি আর বন্ধ হয়নি কখনোই। ১৯৪৮ এ শুরু হওয়া এই মহাবিপর্যয় এখনো অব্যহত আছে। সর্বশেষ পশ্চিম তীরকে যুক্ত করার এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করার ইসরায়েলি প্রত্যয় মহাবিপর্যয়কে আরও ঘনীভূত করেছে।
ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানও জটিল এবং সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। হয়তো আরও দুই যুগ পেরিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্যাপন করবে, তখন হয়তো ফিলিস্তিন নামটা থাকবে ইতিহাসের পাতায়, সংকুচিত হতে থাকা ভূখণ্ড মানচিত্র থেকে মিলিয়েই যাবে। তাহলে কি হবে না ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বতন্ত্র ভূখণ্ড। কবে ফিলিস্তিনিরা আবার স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা মহাবিপর্যয় বা নাকবা শেষ হবে কবে?
Posted ৪:১৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
nykagoj.com | Stuff Reporter