
অর্থনীতি ডেস্ক | রবিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | প্রিন্ট | 147 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মূলে ডলার, রিজার্ভ, বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতির সংকট। সহসা এসব সংকট কাটবে না। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে সবাইকে জানিয়ে সমন্বিতভাবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাই না জানলে সংকট আরও বাড়বে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ঋণনির্ভর। শুধু অবকাঠামো দিয়ে একটি দেশ কখনও উন্নত হতে পারে না। মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে অবকাঠামো উন্নয়ন কঙ্কালসম।
গতকাল অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফ আয়োজিত ‘অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে কথোপকথন’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
আলোচনায় তিনি বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট, ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক, বিদেশি ঋণ, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভালো শিক্ষা ছাড়া যত অবকাঠামোই বানানো হোক না কেন, তা কঙ্কালই থাকবে। শুধু অবকাঠামো দিয়ে আমরা কখনও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে যেতে পারব না। অবকাঠামোর রক্ত-মাংস হলো মানবসম্পদ। যদি শিক্ষার মান না বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়তেই থাকে, তাহলে কোনো লাভ নেই। বিশ্বের দীর্ঘ ৫০ বা ১০০টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের তালিকা নিলে এর মধ্যে চীনের ১০ থেকে ১২টি থাকবে। বাকি সবই উন্নয়নশীল দেশের। এর বিপরীতে সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করলে এসব দেশের নাম পাওয়া যাবে না। এখন অবশ্য চীনের দু-একটা ঢুকছে। কেননা তারা বুঝতে পেরেছে, শুধু অবকাঠামো দিয়ে হবে না। ঋণ নিয়ে অবকাঠামো করে যদি উন্নত হওয়া যেত, তাহলে তো উন্নয়ন অনেক সহজ জিনিস ছিল। দেশকে সহজেই যুক্তরাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা যেত। উন্নয়নের আগে ভাবতে হবে, একসময় না একসময় ঋণের টাকা শোধ করতেই হবে।
তিনি বলেন, গত তিন বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ৫০ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এখনই যে ঋণ বেড়েছে, তাতে তিন-চার বছর পর প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলার করে পরিশোধ করতে হবে। ফলে এখনই পরিকল্পনার দরকার। প্রকল্পের অগ্রাধিকার কী, ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে কিনা, কোনো ত্রুটি আছে কিনা, বাস্তবায়নের দক্ষতা আছে কিনা– এসব দেখতে হবে। পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের কথা বলে প্রকল্প নিয়ে তিন গুণ খরচ বাড়িয়ে ১৫ বছরে করা হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে।
তাঁর মতে, বড় বড় অবকাঠামো মানুষের চলাচলের সুবিধা দেয়। আবার জাতীয় মানসম্মানেরও বিষয় আছে। যে কারণে পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা উচ্চকিত। তবে শুধু ভালোভাবে চলাচলের জন্য এ ধরনের প্রকল্পের ‘কস্ট বেনিফিট’ যথাযথ নয়; বরং বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে কিনা, পরিবহন খরচ কমাতে সহায়ক হচ্ছে কিনা– এসব আসল বিষয়।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, উন্নয়ন একমাত্রিক হলে হয় না। সব দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ থাকতে হয়। শুধু অবকাঠামো দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায় না। এখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগ পেতে সমস্যা হয়। জমি বরাদ্দ পেতে অনেক বেগ পেতে হয়। ভিয়েতনামে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। অথচ বাংলাদেশে আসছে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনাম ২৫ থেকে ৩০টি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। অথচ আমরা এদিকে তেমন খেয়াল করছি না।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশকে সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলতে হবে। নতুন ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে প্রথমে চিন্তা করতে হবে, আমরা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে কাদের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক থাকবে। ভারত ও চীন থেকে আমরা বেশি আমদানি করি। পশ্চিমা দেশ থেকে আমরা তেমন আমদানি করি না, শুধু রপ্তানি করি। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এ কারণে আমাদের চীন ব্লকে যাওয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশের মূল রপ্তানি গন্তব্য পশ্চিমা দেশে।
তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে চীনের ভালো সম্পর্ক হবে না ভূরাজনৈতিক কারণে। ব্রিকস হলো নতুন ভূরাজনীতি। চীন ও রাশিয়ার উদ্দেশ্য, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ করবে। তবে এখানে ভারত দুই দিকেই থাকতে চায়। ব্রিকসে নতুন যারা, তাদের অনেকই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী হতে চায় না। ইরানসহ কিছু দেশ গেছে নিজেদের রক্ষাকবচ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র যখনই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলবে, তখন তারা নিজেদের নতুন শক্তির অংশ হিসেবে দেখাবে।
তিনি বলেন, পশ্চিমারা এখন আর বাজার অর্থনীতির কথা বলে না। তারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে। বাংলাদেশকে তারা মানবাধিকারের কথা বলছে। কারণ বাইডেন প্রশাসন উদাহরণ হিসেবে দেখাতে চায়, তারা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সবাই নিজের স্বার্থেই এসব করে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, মাঝে দেশের অর্থনীতি বেশ ভালো করছিল। তখন আত্মতুষ্টি চলে এসেছিল। অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো করছিল। নিয়মিতভাবে রিজার্ভ বাড়ছিল। কিন্তু তখন কিছু ভুল করে ফেলে। দেশের ভেতরে ক্রমাগত ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হলেও ডলারের দর একই জায়গায় ধরে রাখে। এটি না করে ভারতসহ অন্যান্য দেশের মতো ডলারের দর একটু করে সমন্বয় করলে হঠাৎ এত দর বাড়ত না। আবার রিজার্ভ অনেক বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু একটি দেশের রিজার্ভ যতই বাড়তে থাকুক, তা উন্নয়নের ব্যয়ের জন্য নয়। রিজার্ভ একটি দেশের শক্তি। এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ দেউলিয়া হবে কিনা এমন একটি আলোচনা নতুন এসেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হওয়ায় এমন আলোচনা শুরু হয়। তবে দেউলিয়া না হলেই সব ঠিক আছে, তেমন নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রভাবশালীরা দেশের ভেতরেই ঋণ নিয়ে ফেরত দেয় না। কোন সাহসে তাদের বিদেশি ঋণ নিতে দেওয়া হলো! বিদেশি ঋণ খেলাপি হলে দেশের ইমেজের বিষয়। যে কারণে এখন রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। আবার দেশের ভেতরে সুদহার এক জায়গায় ধরে রেখে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
বাজেট ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতির ব্যবস্থাপনা, বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা, রিজার্ভ নীতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ– এসব একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত। এসবের বিষয়ে যদি সুস্পষ্ট কৌশল না বলা হয়, তাহলে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। এখন কখন কী নীতি হচ্ছে, জানা যাচ্ছে না। কোন কৌশল নেওয়া হচ্ছে, সবাইকে যদি না বলা হয় তাহলে আস্থাহীনতা বাড়ে। যেটুকু সমস্যা তার চেয়ে বড় সমস্যা মনে করে বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কেননা অর্থনীতির এ রকম সময়ে যেসব বিকল্প থাকে, তার কোনোটাই জনতুষ্টিমূলক নয়। অনিশ্চয়তার ফলে ডলারের দামের অস্থিরতা, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো, বিনিয়োগের পরিবেশ, বিদেশি ঋণমান ইত্যাদি ক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়ে। আবার মূল্যস্ফীতি যদি একবার বেড়ে যায় এবং সব ব্যবসায়ী যদি ধরেই নেয় দাম আরও বাড়বে, তখন দাম আসলেই বেড়ে যায়। এ রকম অবস্থায় সমাজে বৈষম্য বাড়ে।
দেশের একটা বড় সমস্যা বিদেশে পুঁজি পাচার। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে অর্থ পাচার বাড়ে। আবার অবৈধ অর্থের মালিকরা যখন মনে করে, এ দেশ থেকে অন্য দেশে নিরাপদ থাকবে, তখন অর্থ পাচার বাড়ে। পাচারের কোনো পরিসংখ্যান আমরা জানি না। তবে বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, সিঙ্গাপুরে হোটেল– এসবই সত্য। একসময় অর্থ পাচার বলতে শুধু ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের কথা বলা হতো। এখন অনেক নতুন নতুন বিষয় এসেছে। দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউসের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে সংগ্রহ করা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকের মালিকরা যদি বাইরে রেখে দেয়, তাহলে তাও অর্থ পাচার। অনেকে বলেন, এখন এভাবেই বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া দ্বৈত নাগরিকত্ব ও স্থায়ী নাগরিকত্ব নিয়ে বিনিয়োগ এবং কোম্পানি খুলে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন অনেকে। ছোটখাটো অনেক ট্রেডারও বাইরে টাকা রেখে দিচ্ছে। অর্থ পাচার মানেই দেশের নিট সম্পদের ক্ষতি। আবার যে পরিমাণ প্রবাসী আয় দেশে আসত, তা আসে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিএফআইইউ আছে, আবার ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়। এত কিছুর পরও বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল। এত টাকা তো কেউ ব্যাগে করে নিয়ে যায় না! কোনো নিয়মনীতি না থাকলে হয়তো মালিকরা ভল্ট খুলে টাকা নিতে পারে। তবে হাজার হাজার কোটি টাকা বেনামি হলেও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা জানতে পারার কথা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, উড়াল সড়ক, পদ্মা সেতু এসব প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। তবে এ জন্য অনেক খরচ করতে হয়। অথচ বিনা খরচে অনেক উন্নয়ন করা যায়। যেমন– যেখানে সেখানে বাস থামানো বন্ধ করা, রাস্তায় হুড়াহুড়ি করে না চলা, দুর্ঘটনা না হওয়া। এসব বন্ধে কোনো পয়সার দরকার নেই। আবার দেশের নদীগুলো চোখের সামনে দখল হচ্ছে। নতুন পিলার দিচ্ছে। সেই পিলার দেওয়া হয়েছে আগের যে নদী ছিল, তা অনেক সংকুচিত করে। এরপরও সেই পিলার ভেঙে বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে। ঢাকার ভেতরে এ অবস্থা। নদী দখলমুক্ত করতে কোনো খরচ দরকার হবে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মূলে ডলার, রিজার্ভ, বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতির সংকট। সহসা এসব সংকট কাটবে না। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে সবাইকে জানিয়ে সমন্বিতভাবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাই না জানলে সংকট আরও বাড়বে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ঋণনির্ভর। শুধু অবকাঠামো দিয়ে একটি দেশ কখনও উন্নত হতে পারে না। মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে অবকাঠামো উন্নয়ন কঙ্কালসম।
গতকাল অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফ আয়োজিত ‘অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে কথোপকথন’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
আলোচনায় তিনি বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট, ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক, বিদেশি ঋণ, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভালো শিক্ষা ছাড়া যত অবকাঠামোই বানানো হোক না কেন, তা কঙ্কালই থাকবে। শুধু অবকাঠামো দিয়ে আমরা কখনও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে যেতে পারব না। অবকাঠামোর রক্ত-মাংস হলো মানবসম্পদ। যদি শিক্ষার মান না বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়তেই থাকে, তাহলে কোনো লাভ নেই। বিশ্বের দীর্ঘ ৫০ বা ১০০টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের তালিকা নিলে এর মধ্যে চীনের ১০ থেকে ১২টি থাকবে। বাকি সবই উন্নয়নশীল দেশের। এর বিপরীতে সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করলে এসব দেশের নাম পাওয়া যাবে না। এখন অবশ্য চীনের দু-একটা ঢুকছে। কেননা তারা বুঝতে পেরেছে, শুধু অবকাঠামো দিয়ে হবে না। ঋণ নিয়ে অবকাঠামো করে যদি উন্নত হওয়া যেত, তাহলে তো উন্নয়ন অনেক সহজ জিনিস ছিল। দেশকে সহজেই যুক্তরাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা যেত। উন্নয়নের আগে ভাবতে হবে, একসময় না একসময় ঋণের টাকা শোধ করতেই হবে।
তিনি বলেন, গত তিন বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ৫০ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এখনই যে ঋণ বেড়েছে, তাতে তিন-চার বছর পর প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলার করে পরিশোধ করতে হবে। ফলে এখনই পরিকল্পনার দরকার। প্রকল্পের অগ্রাধিকার কী, ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে কিনা, কোনো ত্রুটি আছে কিনা, বাস্তবায়নের দক্ষতা আছে কিনা– এসব দেখতে হবে। পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের কথা বলে প্রকল্প নিয়ে তিন গুণ খরচ বাড়িয়ে ১৫ বছরে করা হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে।
তাঁর মতে, বড় বড় অবকাঠামো মানুষের চলাচলের সুবিধা দেয়। আবার জাতীয় মানসম্মানেরও বিষয় আছে। যে কারণে পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা উচ্চকিত। তবে শুধু ভালোভাবে চলাচলের জন্য এ ধরনের প্রকল্পের ‘কস্ট বেনিফিট’ যথাযথ নয়; বরং বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে কিনা, পরিবহন খরচ কমাতে সহায়ক হচ্ছে কিনা– এসব আসল বিষয়।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, উন্নয়ন একমাত্রিক হলে হয় না। সব দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ থাকতে হয়। শুধু অবকাঠামো দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায় না। এখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগ পেতে সমস্যা হয়। জমি বরাদ্দ পেতে অনেক বেগ পেতে হয়। ভিয়েতনামে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। অথচ বাংলাদেশে আসছে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনাম ২৫ থেকে ৩০টি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। অথচ আমরা এদিকে তেমন খেয়াল করছি না।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশকে সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলতে হবে। নতুন ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে প্রথমে চিন্তা করতে হবে, আমরা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে কাদের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক থাকবে। ভারত ও চীন থেকে আমরা বেশি আমদানি করি। পশ্চিমা দেশ থেকে আমরা তেমন আমদানি করি না, শুধু রপ্তানি করি। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এ কারণে আমাদের চীন ব্লকে যাওয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশের মূল রপ্তানি গন্তব্য পশ্চিমা দেশে।
তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে চীনের ভালো সম্পর্ক হবে না ভূরাজনৈতিক কারণে। ব্রিকস হলো নতুন ভূরাজনীতি। চীন ও রাশিয়ার উদ্দেশ্য, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ করবে। তবে এখানে ভারত দুই দিকেই থাকতে চায়। ব্রিকসে নতুন যারা, তাদের অনেকই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী হতে চায় না। ইরানসহ কিছু দেশ গেছে নিজেদের রক্ষাকবচ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র যখনই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলবে, তখন তারা নিজেদের নতুন শক্তির অংশ হিসেবে দেখাবে।
তিনি বলেন, পশ্চিমারা এখন আর বাজার অর্থনীতির কথা বলে না। তারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে। বাংলাদেশকে তারা মানবাধিকারের কথা বলছে। কারণ বাইডেন প্রশাসন উদাহরণ হিসেবে দেখাতে চায়, তারা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সবাই নিজের স্বার্থেই এসব করে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, মাঝে দেশের অর্থনীতি বেশ ভালো করছিল। তখন আত্মতুষ্টি চলে এসেছিল। অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো করছিল। নিয়মিতভাবে রিজার্ভ বাড়ছিল। কিন্তু তখন কিছু ভুল করে ফেলে। দেশের ভেতরে ক্রমাগত ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হলেও ডলারের দর একই জায়গায় ধরে রাখে। এটি না করে ভারতসহ অন্যান্য দেশের মতো ডলারের দর একটু করে সমন্বয় করলে হঠাৎ এত দর বাড়ত না। আবার রিজার্ভ অনেক বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু একটি দেশের রিজার্ভ যতই বাড়তে থাকুক, তা উন্নয়নের ব্যয়ের জন্য নয়। রিজার্ভ একটি দেশের শক্তি। এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ দেউলিয়া হবে কিনা এমন একটি আলোচনা নতুন এসেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হওয়ায় এমন আলোচনা শুরু হয়। তবে দেউলিয়া না হলেই সব ঠিক আছে, তেমন নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রভাবশালীরা দেশের ভেতরেই ঋণ নিয়ে ফেরত দেয় না। কোন সাহসে তাদের বিদেশি ঋণ নিতে দেওয়া হলো! বিদেশি ঋণ খেলাপি হলে দেশের ইমেজের বিষয়। যে কারণে এখন রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। আবার দেশের ভেতরে সুদহার এক জায়গায় ধরে রেখে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
বাজেট ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতির ব্যবস্থাপনা, বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা, রিজার্ভ নীতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ– এসব একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত। এসবের বিষয়ে যদি সুস্পষ্ট কৌশল না বলা হয়, তাহলে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। এখন কখন কী নীতি হচ্ছে, জানা যাচ্ছে না। কোন কৌশল নেওয়া হচ্ছে, সবাইকে যদি না বলা হয় তাহলে আস্থাহীনতা বাড়ে। যেটুকু সমস্যা তার চেয়ে বড় সমস্যা মনে করে বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কেননা অর্থনীতির এ রকম সময়ে যেসব বিকল্প থাকে, তার কোনোটাই জনতুষ্টিমূলক নয়। অনিশ্চয়তার ফলে ডলারের দামের অস্থিরতা, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো, বিনিয়োগের পরিবেশ, বিদেশি ঋণমান ইত্যাদি ক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়ে। আবার মূল্যস্ফীতি যদি একবার বেড়ে যায় এবং সব ব্যবসায়ী যদি ধরেই নেয় দাম আরও বাড়বে, তখন দাম আসলেই বেড়ে যায়। এ রকম অবস্থায় সমাজে বৈষম্য বাড়ে।
দেশের একটা বড় সমস্যা বিদেশে পুঁজি পাচার। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে অর্থ পাচার বাড়ে। আবার অবৈধ অর্থের মালিকরা যখন মনে করে, এ দেশ থেকে অন্য দেশে নিরাপদ থাকবে, তখন অর্থ পাচার বাড়ে। পাচারের কোনো পরিসংখ্যান আমরা জানি না। তবে বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, সিঙ্গাপুরে হোটেল– এসবই সত্য। একসময় অর্থ পাচার বলতে শুধু ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের কথা বলা হতো। এখন অনেক নতুন নতুন বিষয় এসেছে। দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউসের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে সংগ্রহ করা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকের মালিকরা যদি বাইরে রেখে দেয়, তাহলে তাও অর্থ পাচার। অনেকে বলেন, এখন এভাবেই বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া দ্বৈত নাগরিকত্ব ও স্থায়ী নাগরিকত্ব নিয়ে বিনিয়োগ এবং কোম্পানি খুলে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন অনেকে। ছোটখাটো অনেক ট্রেডারও বাইরে টাকা রেখে দিচ্ছে। অর্থ পাচার মানেই দেশের নিট সম্পদের ক্ষতি। আবার যে পরিমাণ প্রবাসী আয় দেশে আসত, তা আসে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিএফআইইউ আছে, আবার ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়। এত কিছুর পরও বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল। এত টাকা তো কেউ ব্যাগে করে নিয়ে যায় না! কোনো নিয়মনীতি না থাকলে হয়তো মালিকরা ভল্ট খুলে টাকা নিতে পারে। তবে হাজার হাজার কোটি টাকা বেনামি হলেও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তা জানতে পারার কথা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, উড়াল সড়ক, পদ্মা সেতু এসব প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। তবে এ জন্য অনেক খরচ করতে হয়। অথচ বিনা খরচে অনেক উন্নয়ন করা যায়। যেমন– যেখানে সেখানে বাস থামানো বন্ধ করা, রাস্তায় হুড়াহুড়ি করে না চলা, দুর্ঘটনা না হওয়া। এসব বন্ধে কোনো পয়সার দরকার নেই। আবার দেশের নদীগুলো চোখের সামনে দখল হচ্ছে। নতুন পিলার দিচ্ছে। সেই পিলার দেওয়া হয়েছে আগের যে নদী ছিল, তা অনেক সংকুচিত করে। এরপরও সেই পিলার ভেঙে বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে। ঢাকার ভেতরে এ অবস্থা। নদী দখলমুক্ত করতে কোনো খরচ দরকার হবে না।
Posted ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
nykagoj.com | Stuff Reporter