হাবিব রহমান | সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট | 149 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
গত শুক্রবার ২৪ এপ্রিল নিউইয়র্ক বাংলাদেশ কনস্যুলেটে “ বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা” শীর্ষক একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছে।অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীড.এ কে মোমেন প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। কনস্যুলেটের আমন্ত্রণে অনেক প্রবাসীও অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
নিঃসন্দেহে রাস্ট্রের পক্ষ থেকে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। বিদেশে এসে প্রবাসীরা যদি দেশের প্রতি তাদের দ্বায়িত্ব কর্তব্যের কথা ভুলে যান রাস্ট্র হিসাবে তা স্মরণ করিয়ে দেয়া নিশ্চয়ই তাদের দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে।সরকারের এই দ্বায়িত্ব সচেতনতার জন্য একজন প্রবাসী হিসাবে আমি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই।
মাননীয় পররাস্ট্র মন্ত্রী একাই যে প্রবাসীদের দেশের প্রতি তাদের দ্বায়িত্ব কর্তব্যের কথা সচেতন করে দিলেন তা নয়।সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী এম পি যারাই প্রবাসে আসেন তাদের অনেকেই নানা অনুষ্ঠানে বক্তব্য বা বিবৃতিতে দেশের প্রতি প্রবাসীদের দ্বায়িত্ব কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলেন না।আমি যদি আরো সোজা সাপ্টা ভাষায় প্রকাশ করি তা হলো তারা প্রবাসীদের আরো বেশী বেশী করে দেশে অর্থ প্রেরণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকেন।
তবে অবশ্য সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের দ্বায়িত্বসচেতন করে তোলার মাত্রা আগের চেয়ে অধিক হারে বেড়েছে।এটা না বল্লেও কারো বুঝতে অসুবিধা হয়না ।এটা দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর একটা উদ্যোগ।দেশে ক্রমেই ডলারের মুল্য বৃদ্ধি,পণ্য আমদানীতে ব্যয় বেড়ে যাওয়া,এবং রিজার্ভ নিম্নগামী হওয়ায় রেমিটযান্স প্রবাহ ঠিক রাখতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতেই এসবের আয়োজন।
আমেরিকার প্রয়াত রাস্ট্রপতি জন এফ কেনেডির একটি বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমার লেখাটি শুরু করতে চাই। তিনি বলেছিলেনঃ
“My fellow Americans, ask not what your country can do for you, ask what you can do for your country.।”
যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়-আমার অ্যামেরিকান স্বদেশবাসীগণ, জিজ্ঞাসা করো না তোমার দেশ তোমার জন্য কি করতে পারে, জিজ্ঞাসা করো তোমার দেশের জন্য তুমি কি করতে পার।
বাংলাদেশ সরকার,তাঁর মন্ত্রী -আমলারা সব সময় দেশের প্রতি প্রবাসীদের দ্বায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চান।আমরা প্রবাসীরা যদি জন এফ কেনেডির সুরে বলি-হে দেশের প্রতিনিধিগন !প্রবাসীদের প্রতি আপনাদের যে দ্বায়িত্ববোধ তার কতটুকু আপনারা পালন করেছেন?
কেউ যদি বাড়ীতে একটা ফলজ গাছ রোপন করেন তাহলে ফল পাবার আগে তাকে সে গাছটির নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়।গরু ছাগলের হাত থেকে বাঁচাতে চারদিকে বেড়া দিতে হয়।গাছের গোড়ায় পানি ঢালতে হয় । সার ,কীটনাশক ব্যবহার করে যত্ন নিতে হয়।তবেই গাছটি একদিন পত্র,ফুলে,ফলে সুশোভিত হতে পারে।
এবার আসুন তাহলে দেখি প্রবাসী নামক টাকার গাছটিকে আমাদের সরকার বা রাস্ট্র কিভাবে পরিচর্যা করে।প্রবাসীদের প্রতি সরকারের দ্বায়িত্ব পালনের নমুনাগুলো একটা একটা করে দেখে নিই।
সরকারী পরিভাষায় যাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলা হয় তাদের বিদেশে যাওয়া এবং ফেরত আসা দুটো প্রক্রিয়াই যেন দুর্ভোগ আর অবহেলার একটা মডেল।শুরুতেই পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ফর্ম পূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অন্তহীন হয়রানির শিকার হন সাধারণ প্রবাসগামীরা।, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের নিজস্ব দালাল বা স্থানীয় সিন্ডিকেটের হাতে তারা জিম্মি।অভিযোগ রয়েছে বিদেশে গমনের পূর্বে মেডিক্যাল চেকআপ থেকে জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রবাসীদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
দীর্ঘ বিড়ম্বনার পর ভিসা পেয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে কাস্টমস্, ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে দালাল ও প্রতারক চক্রের হাতে পদে পদে হয়রানির চিত্র একটা ওপেন সিক্রেট।কখনো স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসীদের সামান্য ভুল বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাথে না থাকাকে কেন্দ্র করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। বিদেশগামীদের বন্ধুসুলভ সহযোগিতা প্রদানের পরিবর্তে অশোভনীয় আচরণ একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।একটা সংবাদ পত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিমানবন্দরে প্রায় ১২ ধাপে হয়রানির শিকার হন প্রবাসগামী যাত্রীরা। বিমানবন্দরে যাত্রীসেবায় নিয়োজিত কাস্টমস্, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ও বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ মিডিয়ায় প্রচার করা হলেও এর খুব একটা প্রতিকার মিলেনা।এমনকি প্রধানমন্ত্রী দফতর থেকে যাত্রী হয়রানির বন্ধে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা কার্যকর করা হয় খুব কমই।
বিদেশে গিয়েও হয়রানী প্রবাসীদের পিছু ছাড়ে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের দূতাবাস কর্তৃক যথাযথ সেবা না দিতে পারার অভিযোগও অনেক পুরনো।বিশেষ করে বিদেশে শ্রম উইংগুলো, দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার, পাসপোর্ট করতে অতিরিক্ত টাকা দাবি, অসহযোগীমূলক মনোভাবের ঘটনার কথা সোস্যাল মিডিয়ার কল্যানে সহজেই চোখে পড়ে ।যে কারণে শত সমস্যায় জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীরা সহজে দূতাবাসমুখী হতে চান না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রবাসীদের সর্বশান্ত করার আরেকটি নাম হলো দালাল চক্র। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক ভিসায় বিদেশে যেতে মোটা দাগে মাথাপিছু খরচ হয় ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। বড় অঙ্কের এই ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ যায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের পকেটে। এইসব দালাল চক্রের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে অবৈধ অভিবাসন। এই দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্দিষ্ট কাঠামো ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে নানা সময় নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিছু বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থাও কাজ করছে। কিন্তু অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। এখনো প্রতারিত হচ্ছে শ্রমিক। অবৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করা যায়নি।
প্রবাস থেকে যারা দেশে আসেন তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের পরিবার পরিজন।বিদেশ থেকে সবার জন্য নানান কিছু নিয়ে আসবেন এটাই সবার প্রত্যাশা থাকে। প্রবাসীরা নিজ নিজ সাধ্যমত আত্মীয়স্বজনের জন্য বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন ।একটি ছোট খাট লাগেজের মধ্য লুকিয়ে থাকে প্রাসীদের এক একটি স্বপ্ন। ঢাকা বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাগেজসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাগ চুরি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।এ নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি হয় ।কিন্তু কতজন প্রবাসী তাদের মালামাল ফেরত পান তার খোঁজ কেউ রাখেনা।একজন প্রবাসীর কষ্টের মালামাল যদি দেশএসে বিমান বন্দরের নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে চুরি হয়ে যায় এর কষ্ট একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝেন।
বিমান বন্দরে ট্রলির সংকটে প্রবাসীদের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।অনেক যাত্রীকে মাথায় ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে দেখা যায়।শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয় কিন্তু কি দূর্ভাগ্য আমাদের সামান্য কয়টা অতিরিক্ত ট্রলি কেনার টাকা বাজেটে থাকেনা।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও দেশে টাকা পাঠানোর মেশিন বা টাকার গাছ এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ন্যূনতম কোনো মর্যাদা নেই।বিদেশে কোনো প্রবাসী মারা গেলে সরকারিভাবে তার লাশটা পর্যন্ত দেশের মাটিতে আনার কোন ব্যবস্থা নেই।
দুস্টচক্রের হাতে প্রবাসীদের জায়গা জমি বেহাত হওয়া নিয়মিত ঘটনা।ভূমি ও সাব রেজিস্টার অফিসে একশ্রেনীর দুর্নীতিবীজ চক্র সূদুর অতীত থেকে সক্রিয়।ভূয়া নামজারির মাধ্যমে প্রবাসীর সম্প্রতি অন্যের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ অতি পুরনো। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রবাসীরা এর সহজ সমাধান পান না।এ ছাড়া অন্যান্য নানান অবহেলা তো আছেই।
গত কয়েকমাস আগে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার প্রথম পাতায় একটা আশংকাজনক খবর প্রকাশিত হয়েছিলো।খবরের শিরোনামটি ছিলো-দেশ মুখী হতে উত্তরাধিকারীদের অনীহা এবং বেহাত হওয়ার শংকায় দেশের সম্পত্তি বিক্রি করছেন প্রবাসীরা।খবরে বলা হয়,নতুন প্রজন্মের অনেকেই দেশে থাকা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি দেখভাল করাকে ঝামেলাপূর্ণ মনে করছেন।
আমরা প্রবাসীরা মনে করি সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে নতুন প্রজন্মের এই ভীতি কমানোর।তারা যদি দেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তা পরবর্তীকে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশংকাজনক ভাবে কমে যাবে যা হবে দেশ এ জাতির জন্য চরম ক্ষতিকর।
আমাদের দাবী সমুহঃ
বিদেশে মৃত প্রবাসী বাংলাদেশিদের লাশ দূতাবাসের মাধ্যমে সরকারী খরচে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা।
দেশে প্রবাসীদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ,মেডিক্যাল কলেজ,ইনজিনিয়ারিং কলেজ,ও সশস্র বাহিনীতে নির্দিষ্ট কোটা চালু করা।
দেশে আসা প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে সু-নজর রাখা এবং দেশে প্রবাসীর পরিবারগুলোকে নানারকম অন্যায় অবিচার থেকে রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক নিরাপত্তা দেয়া।
সকল প্রবাসীদের বীমার আওতায় নিয়ে আসা, যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীরা বীমার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন।
প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণের উপর ভিত্তি করে তাদের জন্য এককালীন পেনশন স্কিম ও ইন্স্যুরেন্সের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করা ।এতে বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ যেমন বাড়বে তেমনি প্রবাসজীবন শেষে পরিবার-পরিজন নিয়ে একটা নিশ্চিত জীবন যাপন করা সম্ভব হবে।
প্রবাসীদের সম্পত্তি যাতে বেহাত না হয় তার উদ্যোগ নেয়া।বেহাত হওয়া সম্পত্তি দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনে বিশেষ কোর্টের ব্যবস্হা করা।
নতুন প্রজন্ম যেন দেশের প্রতি আগ্রহী হয় সে জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া।
আর এসব সমস্যা সমাধানে যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়,শর্ষের মাঝে যে ভূত আছে তা তাড়ানোর ব্যবস্হা হয় তাহলে দেশের প্রতি যেমন একদিকে প্রবাসীদের ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে তেমনি বিনিয়োগ বাড়বে এবং নিজের দ্বায়িত্বেই তারা আরো বেশী বেশী রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্যোগি হবেন।সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বার বার প্রবাসে এসে সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে প্ররাসীদের দেশের প্রতি দ্বায়িত্ব সচেতন করার প্রয়োজন পড়বে বলে আমি মনে করিনা।
ব্যাপারটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন এই প্রত্যাশাসকলের সাথে আমাদের ।
নিউইয়র্ক।
২৬ ফেব্রুয়ারী,২৩।
Posted ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
nykagoj.com | Monwarul Islam