
মনজুর আহমদ | শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫ | প্রিন্ট | 39 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
একটা প্রশংসনীয় কাজ করেছে কৃষ্টি। তিন দিনের এক নাট্যোৎসবের চমৎকার আয়োজন করেছিল তারা গত সপ্তাহে শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত জ্যামাইকার জেসিএএল মিলনায়তনে। প্রতিদিন দুটি করে মোট ছয়টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এই উৎসবে। হয়েছে নাটক নিয়ে সেমিনার।
তবে আমার মনে হয়েছে, কৃষ্টি সবচেয়ে বড় কাজ যেটি করেছে তা হলো নাট্যকর্মীদের এক অভূতপূর্ব মিলনমেলার আয়োজন। এ মিলনমেলা ছিল ভিন্নধর্মী, ভিন্ন অঙ্গিকের। এই প্রবাসে, এই নিউইয়র্কে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে যারা বাংলা নাট্যচর্চায় নিবেদিতভাবে কাজ করে চলেছেন এক মঞ্চে তুলে যথাযোগ্য মর্যাদায় তাদেরকে সম্মাননা জানান হয়েছে। যে সব নাট্য সংগঠন নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বাংলা নাট্য চর্চাকে এগিয়ে নিতে সেই সব সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা নাট্যজনদের প্রতি নিবেদন করা হয়েছে শ্রদ্ধা। প্রবাসের নাট্য আন্দোলনে তাদের অবদানের প্রতি এমন স্বীকৃতি নাট্য উৎসবকে মহিমান্বিত করেছে। মঞ্চে আহ্বান জানান হয়েছিল নিউইয়র্কের প্রাচীণতম নাট্য সংগঠন বাংলাদেশ থিয়েটার অব আমেরিকার স্বপ্না কাওসারকে, থিয়েটার সাপোর্ট গ্রুপের শামসুল আলম বকুল, ঢাকা ড্রামার টিটু গাজী, থিয়েটার ৭১—এর খায়রুল আলম পাখি, থিয়েটার থিয়েটারের মিথুন আহমেদ, ড্রামা সার্কলের আবীর অলমগীর, শিল্পাঙ্গনের নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভের ড. বাবুল বিশ্বাস এবং নিউইয়র্কে অবস্থানরত ঢাকার নাট্য ব্যক্তিত্ব রোকেয়া রফিক বেবী, মাসুম রেজা ও মোমেনা চৌধুরীকে। একই সাথে পুষ্পস্তবক ও উত্তরীয়তে ভূষিত করে শ্রদ্ধা—ভালবাসায় ভরিয়ে তোলা হয় প্রবাসের দুই প্রবীণতম নাট্য ব্যক্তিত্ব রেখা আহমেদ ও মুজিব বিন হককে। এই পুরো আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবাসের নাট্যজনদের সম্মানিত করার এই উদ্যোগ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আপ্লুত করেছে। কৃষ্টির কর্ণধার শীতেস ধরকে আমার অভিনন্দন।
নাট্য উৎসবটি উৎসর্গীত ছিল বাংলাদেশের ভিন্ন ধারার নাটকের এক অক্লান্ত যোদ্ধা অকাল প্রয়াত ইশরাত নিশাতের স্মরণে। ইশরাত নিশাত দুবার নিউইয়র্কে এসেছিলেন দুটি নাটকের নির্দেশনা দিতে। এখানে তিনি মঞ্চস্থ করে গেছেন হাসন রাজা। বিভিন্ন বক্তা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার প্রতি। উৎসবের উদ্বোধন করেন আইটিআই বাংলাদেশ সেন্টারের সভাপতি অধ্যাপক আবদুস সেলিম। সংবর্ধিত নাট্যজনেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
নাট্য উৎসবের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশের খ্যাতিমান মঞ্চাভিনেত্রী রোকেয়া রফিক বেবীর একক পরিবেশনা ‘সাইকোসিস’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। সারাহ কেন—এর মূল নাটক থেকে গ্রহণ করা সাইকোসিসের বিষয়বস্তু জটিল মনস্তাত্ত্বিক। চিরাচরিত কাহিনী এ নাটকে গড়ে ওঠেনি, এখানে বিধৃত হয়েছে এক মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের কথা। এ নাটক দর্শকদের টেনে নিয়ে যায় ভগ্ন হৃদয় এক মানুষের অভিযাত্রার নানা পর্যায়ের আত্মোপলব্ধি, দ্বিধা, সংশয়ের দিকে। টেনে নিয়ে যায় জীবনবোধের গভীরতায়। এ জীবনবোধে আছে বেদনা, আছে দুঃখ, আছে আত্মহননের আকাক্সক্ষা। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ এক ভিন্ন প্রত্যাঘাতে সেখান থেকে ফিরে আসে। অবিস্কার করে এ তার একক মনের অভিব্যক্তির প্রকাশ নয়, তার চতুষ্পার্শের পুরো পরিমন্ডলই এই বেদনায় আক্রান্ত, বেদনার্ত।
এই জটিল মনস্তাত্ত্বিক নাটক পিন পতন নিস্তব্ধতায় দর্শকরা উপভোগ করেছেন রোকেয়া রফিক বেবীর অভিনয় নৈপুন্যের কারণে। ঢাকা থিয়েটার আর্ট ইউনিটের মিউজিক এবং বাবর খাদেমীর আলোকসম্পাতে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল রোকেয়া রফিক বেবীর পরিবেশনা।
এদিনের দ্বিতীয় নাটক ছিল ‘দি গেম’। এটিও ছিল একটি অনুবাদ কর্ম। এ নাটকেরও বিষয়বস্তু জীবন—মৃত্যুর টানাপোড়েন। হতাশাগ্রস্ত তরুণ—তরুণী যখন আত্মহননের তীব্র আকাক্সক্ষায় আক্রান্ত জীবন তখন তাদেরকে তার পক্ষে আহ্বান জানায়। কিন্তু মৃত্যুর হাতছানিও তো অমোঘ। সেই হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবনের জয়গান গাওয়াই তো মানুষের ধর্ম। লুইস ব্রায়ান্টের মূল লেখা থেকে রুবাইয়াত আহমদের অনুবাদ করা এই নাটকে অভিনয়ে ছিলেন শুক্লা রায়, কামাল মোহাম্মদ, সিফাত উদ্দিন পলক এবং দীপা দেবনাথ। সঙ্গীতে ছিলেন শফিকুল ইসলাম আর আলোকসম্পাতে বাবর খাদেমী।
দ্বিতীয় দিনের নাটক ছিল কানাডা নাট্য সংঘের ‘তিন মাতালের কান্ড’ আর ঢাকা ড্রামার ‘সংকটে শয়তান’। সুব্রত পুরু নির্দেশিত তিন মাতালের কান্ড নাটকের অভিনয়ে ছিলেন অনুপ সেনগুপ্ত, সুভাষ দাস, রোমি মজুমদার, আবদুর রহমান আরিফ, তাপস দেব, আশরাফ রানা, নাহিদ আশরাফি ও কামরুন খান সুইটি। সঙ্গীতে ছিলেন মামুন কায়সার। সংকটে শয়তান—এর অভিনয়ে ছিলেন বসুনিয়া সুমন, প্রতিমা সুমি এবং বাবর খাদেমী। নির্দেশনা বাবর খাদেমীর।
শেষ দিনে মাতিয়ে দিলেন মোমেনা চৌধুরী। তিনি মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন তার একক অভিনীত ‘গোধূলি বেলায়’। একজন পঞ্চাশোর্ধ বিধবা নারীর জীবন কাহিনী। এ কাহিনী তিনি সবিস্তারে বলে চলেছিলেন তার বিবাহ বার্ষিকীতে সুসজ্জিত হয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে তার নিত্যদিনের দেখা—সাক্ষাৎ হওয়া বান্ধবীদের কাছে। বলে চলেছিলেন তার ছাত্রী জীবন, তার প্রেম, সুখী বিবাহিত জীবন, স্বামীর অকাল প্রয়াণের কথা। এ সবই ছিল তার যাপিত জীবনের স্বাভাবিক পথ পরিক্রমায় এগিয়ে চলার কাহিনী। কিন্তু তার এই জীবনের ছন্দপতন ঘটল, সব কিছুই অস্বাভাবিক হয়ে উঠল তার ছোট মেয়ের জীবনে নেমে আসা বিপর্যয়ের কারণে। মেয়ের প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতা, তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, সেই ধর্ষণের ঘটনার ভিডিও ধারণ ও তা ছড়িয়ে দেয়ার হুমকির ঘটনায় বদলে গেল তার গতানুগতিক জীবনের গতিধারা। সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি চিৎকার করে বিচার চাইলেন। তিনি হয়ে উঠলেন এক লড়াকু মাতা।
এ চালচিত্র আজকের বাংলাদেশে নতুন নয়। নিত্য—নিয়ত ঘটে চলেছে ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষিতাদের হাহকার প্রতিধ্বনি তুলে ফেরে আকাশে—বাতাসে। তারা বিচার পায় না। ধর্ষকদের বিচার হয় না। মামলা হলেও তারা জামিন পেয়ে দেশ ত্যাগ করে, নয়ত হুমকিÑধামকি দেয়। ধর্ষিতাকে বেছে নিতে হয় আত্মহননের পথ। এই বিধবা মা তার মেয়েকে নিয়ে সমাজের এই কুৎসিত অনাচারের বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন লড়াই। কিন্তু পারেননি। তার মেয়ে আত্মহত্যা করে। চিঠিতে মাকে লিখে যায়, মা আমি পারলাম না। তুমি লড়াইটা চালিয়ে যেও। হঁ্যা, ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবীতে বাংলাদেশের নারী সমাজের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। তাদের এই লড়াই যুগ যুগের, তাদের লড়াই আপোসহীন, তাদের লড়াইয়ের শেষ নেই।
ভিন্ন ভিন্ন মেজাজে, ভিন ভিন্ন অভিব্যক্তিতে এবং মা—মেয়ের দ্বৈত চরিত্রে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের একক অভিনয়ে মোমেনা চৌধুরী মুগ্ধ করে দিলেন দর্শকদের।
এদিনের শেষ নাটক ছিল ‘হ্যামলেট ও ওফেলিয়া’। শেকসপীয়ারের হ্যামলেট থেকে নেয়া এ কাহিনীর নাট্যরূপ মাসুদ সুমনের। মূল অনুবাদ সৈয়দ শামসুল হকের। হ্যামলেট—ওফিলিয়ার প্রেম, হ্যামলেটের অস্বাভাবিক আচরণ, এবং শেষ অব্দি ওফেলিয়ার আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি এই নাটকের। অভিনয়ে মাসুদ সুমনের সঙ্গে ছিলেন মুমু মাসুদ, মুসা রুবেল, ফিলিপ লিটন, তানভির আহমদ ও জীবন বিশ্বাস। নির্দেশনা ছিল মাসুদ সুমনের। শেকসপীয়ারের নাটক, যেখানে শরীরি ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ, সেখানে মাসুদ সুমন, মুমু মাসুদ নিঃসন্দেহে ভাল করেছেন। অন্যদের অভিনয়ও ছিল মানসম্পন্ন। সব মিলিয়ে নাটকটি হয়ে উঠেছিল উপভোগ্য।
Posted ৯:৪৪ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
nykagoj.com | Monwarul Islam