বাংলাদেশ ডেস্ক | বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪ | প্রিন্ট | 21 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়া ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা বিষয় জানতে চেয়েছেন ঢাকা সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিদ্যমান ব্যবস্থার যে সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে, তাতে মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন তিনি। আইনগুলোর সংস্কার এমনভাবে হয়, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ না থাকে। এ ছাড়া ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
গতকাল সকালে সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক দিয়ে ঢাকা সফরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধান। সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে বিচারকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন আইনগত সংস্কারে জড়িত। এ ছাড়া ফরেনসিক ও কারিগরি সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তারা।
বৈঠকে ভলকার তুর্ককে আশ্বস্ত করে আসিফ নজরুল বলেন, এই ট্রাইব্যুনালে সুবিচার করা হবে। প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা থেকে এটা করা হচ্ছে না। অবিচার করার জন্য আগের আদালতে যে রকম হয়েছে, সে রকম অবিচার করা হবে না। এখানে কোনো কিছু লুকানোর নেই। যে কেউ এসে এই বিচার দেখতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে দুটি প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি বিচার বিভাগ স্বাধীন করা। এ বিষয়ে ভলকার তুর্ককে বলেছি, আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা এটি নীতিগতভাবে গ্রহণ করি। এর ‘মডালিটিস’ কেমন হবে, সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে। এটা ছাড়াও বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালত নিয়ে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে কী কী সংস্কার ভাবনা রয়েছে, সেটা হাইকমিশনারকে জানানো হয়েছে। তিনি এসব বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করা যায় কিনা, সে বিষয়ে ভলকার তুর্ক কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বলেছি, এটি বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের ফৌজদারি বিচার ও শত বছরের বিচারিক পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যে ফ্যাসিস্টদের হাতে হাজার হাজার তরুণ নিহত হয়েছে, তাদের হত্যার বিচার সামনে রেখে হঠাৎ করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করার প্রশ্নই আসে না। তা ছাড়া যে কোনো বড় ধরনের আইনগত পরিবর্তন সমাজ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিল রেখে করতে হয়।
আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ভলকার তুর্ক বলেন, আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কথা বলেছি। এ দুটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্তমান সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, সে ক্ষেত্রে মানবাধিকার যেন নিশ্চিত করা হয়, তা বলেছি।
আইন উপদেষ্টার পর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন হাইকমিশনার। গতকাল দুপুরে বৈঠক নিয়ে ব্রিফিংয়ে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষী সুরক্ষা ও ভিকটিম সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নিশ্চিতকরণের পরামর্শ প্রদান করে। তিনি বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে মূলত আলোচনা হয়েছে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে। এ ইস্যুতে আমরা যেন তাদের সহযোগিতা করি, তারা এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছেন। তা ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উত্তরণ ও বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের কাজেও তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে মানবাধিকার প্রতিনিধি দল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে যাচাই-বাছাই ও স্ক্রিনিং করার পরামর্শ দেয়। তবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ যে ভালো পারফর্ম করছে, সে বিষয়ে তারা প্রশংসা করেছে। তা ছাড়া পুলিশ সংস্কার কমিশনে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে যেন গুরুত্ব প্রদান করা হয়, সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা জাতিসংঘের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছি। যদিও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসন বিষয়ে আমাদের সাহায্য করছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এটি অনেক কম। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে সহিংস পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আরও কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সে জন্য জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণে চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছি।
উপদেষ্টা বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হার অনেক কম এবং দিন দিন পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটছে।
বিকেলে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কিনা এবং মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ ঘোষিত নীতিমালা কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেন ভলকার তুর্ক। প্রধান বিচারপতি দেশের আইন অনুযায়ী বিচার বিভাগে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন বলে মানবাধিকার হাইকমিশনারকে আশ্বস্ত করেন। এ ছাড়া বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় বাংলাদেশের আইনে মৃত্যুদণ্ড থাকার যে বিধান রয়েছে, সেটি রহিত করার বিষয়ে প্রধান বিচারপতির মনোভাব জানতে চেয়েছে জাতিসংঘ।
এর আগে দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ বৈঠকে অংশ নেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার। বৈঠক শেষে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, শিগগির ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় করা হবে। একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত হয়েছে। কার্যালয় চালু হলে সবচেয়ে বেশি যে সুবিধা হবে তা হলো, মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ক্ষেত্রগুলো, মানবাধিকার পরিষদ সরাসরি তদন্ত করতে পারবে। এখানে কার্যালয় থাকা মানে মানবাধিকারের জায়গা থেকে আমাদের শক্তি বাড়ল।
অপরাধের তদন্ত হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, চলে যায়। তারা যদি নিজেদের অপরাধের তদন্ত করে, সে তদন্ত তো হয় না। নাগরিক সমাজ থেকে যখন তদন্ত করা হয় অথবা সত্যটা যখন তুলে ধরা হয়, তখন তাদের ওপর নির্যাতন আসে এবং নানা চাপের মুখে থাকতে হয়। সেই কথাগুলো ব্যক্ত করা যায় না, রিপোর্টও করা যায় না।
এ সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, সরকারের দায়িত্ব মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়। জাতিসংঘ সহায়তামূলক অবস্থান থেকে এখানে এসেছে।
পরে বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে দিনের কর্মসূচি শেষ করেন ভলকার তুর্ক। সেখানে বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যে সাহস দেখিয়েছেন ও আত্মত্যাগ করেছেন, তাতে আমরা অনুপ্রাণিত। এটা আপনাদের যাত্রা। আর এ যাত্রাপথে আমরা সহযোগিতা নিয়ে আপনাদের পাশে রয়েছি। আমার কার্যালয় তার ভূমিকা রাখার জন্য প্রস্তুত। যা শুরু হয়েছে তথ্য অনুসন্ধান মিশন শুরুর মধ্য দিয়ে।
হাইকমিশনার বলেন, মানবাধিকার সামনে রেখে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, সংকুচিত নাগরিক স্থান আবারও তৈরি করা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং নিরাময় প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে আমি আলোচনা করব। আমি আপনাদের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ ও নানা বিষয়ে জানার অপেক্ষায় থাকব।
ভলকার তুর্ক বলেন, বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি, সংস্কৃতি এবং সৃজনশীলতার একটি সমৃদ্ধ উদাহরণ। বাংলাদেশ তার সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই তার সীমা নির্ধারণ করতে হবে। যেখানে বৈষম্য, প্রতিশোধ ও প্রতিশোধের প্রবণতা, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে অবশ্যই দূরে রাখতে হবে। যেন কোনো পুনরাবৃত্তি না হয়।
আজ সকালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সব সংস্কার কমিটির প্রধান এবং জোরপূর্বক গুমবিষয়ক কমিশনের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। এ বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন হাইকমিশনার। এর পর সেনাসদরে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আহতদের দেখতে যাওয়ার কথা রয়েছে। বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তিনি। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ভলকার তুর্কের ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।
Posted ৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪
nykagoj.com | Stuff Reporter