বৃহস্পতিবার ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক

খেলা ডেস্ক   |   মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   42 বার পঠিত   |   পড়ুন মিনিটে

বাংলাদেশের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক

অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ…। ফিফা দ্য বেস্টের গালা অনুষ্ঠানই হোক কিংবা উয়েফার বর্ষসেরা পুরস্কার। যে কণ্ঠের সঙ্গে ভীষণভাবে পরিচিত ফুটবলবিশ্ব, সেই রেশমিন চৌধুরীর শেকড় যে বাংলাদেশে, তা অনেকেরই জানা। এটাও জানা, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিক রয়টার্স, আইটিএন, ব্লুমবার্গ, রিয়াল মাদ্রিদ টিভি, বিবিসি স্পোর্ট, বেন স্পোর্ট, টিএনটি স্পোর্টস হয়ে বর্তমানে কাজ করছেন টক স্পোর্টে। প্রয়াত বাবা শাহাব উদ্দিন চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটা বইয়ের প্রকাশনী অনুষ্ঠান করতে ১৮ বছর পর মাকে নিয়ে এসেছেন দেশে। আনন্দিত তিনি প্রিয় ঢাকার কসমোপলিটনের রূপান্তর দেখে। খুশি তিনি নারী ক্রিকেট ও ফুটবলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দেখে। আফসোস তাঁর পদ্মা সেতু দিয়ে বাবাকে নিয়ে একবার ফরিদপুরের ভাঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে যেতে না পারার। লন্ডন থেকে ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসে সঙ্গে এক সন্ধ্যায় মনের জানালা খুলে দিয়েছেন রেশমিন। শুনিয়েছেন একজন বাংলাদেশি মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে কীভাবে, কতটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি আজ খেলাধুলার বিশ্ব মিডিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরিবারের সমর্থন, নিজের বিশ্বাস আর ইচ্ছাশক্তির প্রতি প্রবল আস্থা থাকলে, বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে আপনভাবে মিশলে একজন রেশমিন চৌধুরী হওয়া যায় সেই গল্পও বলেছেন। শুনিয়েছেন বছর চার আগে কীভাবে উয়েফার অনুষ্ঠানে মেসি আর রোনালদোকে পাশাপাশি বসিয়ে তাদের নীরব বন্ধুত্বের কথা আবিষ্কার করেছিলেন, কীভাবে ইংলিশের পাশাপাশি ফ্রান্সের একটি ছোট্ট শহরে গিয়ে ফ্রেঞ্চ আর সেভিয়া গিয়ে স্প্যানিশ রপ্ত করেছেন। জিদান, বেকহাম, বেনজামাদের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক বন্ধুত্বের কথাও শুনিয়েছেন এবং অবশ্য সে কথাটিও জোর দিয়ে বলেছেন- আমার জন্ম ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কটা তো তাঁর শুধু রক্তের নয়, আত্মারও।

চোস্ত স্প্যানিশ বলে মেসিকে হাসানো কিংবা ফ্রেঞ্চ বলে জিদানের প্রশংসা কুড়ানো সে তো আর চাট্টিখানি কথা না। এএফসি অ্যাওয়ার্ডজয়ী সেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ক্রীড়া সাংবাদিক রেশমিন চৌধুরী যখন জানালেন ছেলেবেলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুল গীতি গাইতেন, তখন আর তা জেনে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। জন্ম, পড়ালেখা, বেড়ে ওঠা- সব লন্ডনে হলেও বিশুদ্ধ এক বাংলাদেশি পরিবারে বাঙালিয়ানার সবটুকু স্পর্শই লালিত করেন রেশমিন। তাই লন্ডনে কমিউনিটির কেউ যখন তাঁকে ‘ফরেনার’ বলেন, তখন ভীষণ কষ্ট পান তিনি। গান আর মঞ্চ নাটক থেকে কীভাবে কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব ফুটবলের বিখ্যাত সব চ্যানেলে ব্রডকাস্ট জার্নালিজম করছেন, ফিফা-উয়েফার অনুষ্ঠানগুলোতে কীভাবে উপস্থাপনা করেছেন, মেসি-রোনালদো থেকে শুরু করে বেকহাম-জিদানের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার কীভাবে নিয়েছেন- সব গল্প করলেন রেশমিন বনানীতে তাঁর খালার ফ্ল্যাটে বসে। মাঝে মোবাইল স্ক্রিনে হোয়াটসঅ্যাপ অ্যালার্ট দেখে চোখ বুলিয়েই মিষ্টি হেসে নিলেন ‘যাক, লিগ কাপটা লিভারপুলই পেল। ক্লপ এটা ডিজার্ভ করেন।’ কথা ছিল ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় নেওয়ার। কিন্তু কোথা দিয়ে রেকর্ডিং ৫৩ মিনিট হয়ে গেল, তা টেরই পেলেন না সঞ্জয় সাহা পিয়াল।

বাংলাদেশে স্বাগত আপনাকে, কত বছর পর আসা হলো এবার?
রেশমিন: অনেক বছর পর, তা প্রায় ১৮ বছর হয়ে গেল শেষবার যখন এসেছিলাম। ছোটবেলায় দুই বছর পরপরই বাবা-মা, ভাইয়ের সঙ্গে আসতাম। তখন আমাদের স্কুলে সামার হলিডে থাকত। এয়ারপোর্টে ২০ থেকে ৩০ জন আত্মীয় আমাদের রিসিভ করতে আসতেন। সে এক দারুণ সময় ছিল। আমরা ঢাকায় চাচার বাসায়, খালাদের বাসায় দাওয়াত খেতে যেতাম। এখন তো চাকরি, ট্রাভেল আর কাজের চাপে অনেক দিন আসা হয় না। এবার এসে ঢাকায় অনেক পরিবর্তন দেখলাম। বড় বড় বিল্ডিং, এক্সপ্রেসওয়ে- সব মিলিয়ে ঢাকা এখন কসমোপলিটন সিটি। এটা ইতিবাচক।

আপনার বাবা-মার লন্ডনে যাওয়ার গল্পটা যদি শোনাতেন
রেশমিন: আমার বাবা শাহাব উদ্দিন চৌধুরীর বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। সেখানেই হাইস্কুল পাস করে ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার ১০ জন মেধাবী ছাত্রকে লন্ডনে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে পাঠায়। বাবা ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৭১ সালে লন্ডনের ট্রাফেলগার চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে বাবা সক্রিয় ছিলেন। ওই সময় বাবা ব্রিটিশ দৈনিক ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন মিডিয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খবর বেরোলে তা খুঁজে খুঁজে বের করে সংগ্রহে রাখতেন। মূলত তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে সেসব নিয়েই একটা বই প্রকাশ করতে যাচ্ছি। সে জন্যই এবার ঢাকায় আসা। আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সে সময় অনেক বাংলাদেশি মিলে লন্ডনে বড় একটা কমিউনিটি ছিল। সেখানেই সুন্দর একটা সময় কাটিয়েছিলাম আমরা। তা ছাড়া আমার জন্ম ১৬ ডিসেম্বর আর আমি যেদিন ড্রাইভিং লাইসেন্স পাই, সেটাও ছিল কোনো এক ২১ ফেব্রুয়ারি। তাই আমি সব সময় গর্ব করেই বলি- বাংলাদেশের সঙ্গে আমার বিশেষ একটা যোগাযোগ রয়েছে। বাবা চাইতেন লন্ডনের দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিরা যেন তাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে না যান। সে কারণেই হয়তো বাড়িতে আমাদের হারমোনিয়ামে রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুল গীতির চল ছিল। বাবার কাছ থেকেই গান গাইতে শিখেছি।

একজন মুসলিম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেয়ের জন্য লন্ডনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাটা কতটা চ্যালেঞ্জের ছিল?

রেশমিন: চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে সেটা অত বড় কিছু ছিল না। সেখানে আমাদের দ্বৈত সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠতে হয়েছে। তবে বাড়িতে এবং কমিউনিটিতে আমাদের বাংলাদেশি সংস্কৃতি এতটাই গভীরে ছিল, তাতে অন্য কিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। যেমন আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতাম। আমরা বাংলা নববর্ষ থেকে শুরু করে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতাম। আমি একই সঙ্গে ব্রিটিশও, তবে আমি দ্বৈত সংস্কৃতির সঙ্গে স্বচ্ছন্দ ছিলাম। আমি যে বাঙালি, সেটা কখনও ব্রিটিশদের কাছে লুকাতে চাইনি। আমি ভাগ্যবান, আমার মা-বাবা আমাকে ভীষণভাবে সাপোর্ট করেছিলেন। আমি সবাইকে বলি- আমি সাদা না, আমি বাঙালি মুসলিম। অনেক কষ্ঠ করে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। একজন ইংরেজ মেয়ে বুঝবে না, এখানে আসতে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে। সুতরাং আমি সবাইকে বলি, আমার সঙ্গে সবার ব্যাপারটা মেলালে চলবে না।

এখানে আসার আগে গুগলে সার্চ দিয়ে আপনার জীবনবৃত্তান্ত খুঁজছিলাম। সেখানেই দেখলাম আপনি থিয়েটারে কণ্ঠ দিতেন এবং ভালো গানও গাইতেন
রেশমিন: সত্যি বলতে, আগে যখন দেশের গান গাইতাম, তখন সেই ফিলিংসটা ছিল না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই গানগুলোর কথা বুঝতে শিখেছি। গানের শিল্পী আমি কখনোই হতে চাইনি। তবে গানের কারণেই আজ আমার পেশাতে যে কণ্ঠ দিতে হয়, তা কাজে দিয়েছে। স্টেজ থিয়েটার করেছিলাম বলেই ছোটবেলা থেকে সবার সামনে পারফর্ম করার ভয়টা কেটেছে। যেগুলো আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে প্রচণ্ডভাবে।

আপনার মধ্যে প্রচণ্ড একটা কনফিডেন্স সব সময় উজ্জ্বল করে থাকে
রেশমিন: এটা আসলে একজন মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই গ্রো করতে হয়। লোকে অনেক কথাই বলবে, কিন্তু একজন মেয়েকে সেটাতেই ভরসা রাখতে হবে, যেটা সে নিজে বিশ্বাস করে। কেউ একজন বলে দিল তোমাকে দিয়ে ওটা হবে না- সেটা শুনে বসে থাকলে তো কিছুই হবে না। অবশ্যই তোমার মধ্যে ট্যালেন্ট থাকতে হবে। তার পর যেটা ইচ্ছা হয়, সেটাই করতে হবে। যখন আমি স্প্যানিশ শিখতে স্পেনে গিয়েছিলাম, তখন কি জানতাম একদিন রিয়াল মাদ্রিদ টিভিতেই আমাকে কাজ করতে হবে। আরেকটি কথা, তা হলো সবার সঙ্গে মিশতে হবে। সবার সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে, তাহলে মেধার বিকাশ ঘটবে।

এবার বলুন, আপনার স্পোর্টসে আসাটা কীভাবে?

রেশমিন: ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা ছিল। তবে ১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপ যখন প্রথম টেলিভিশনে দেখি, তার পর থেকেই খেলাটি নিয়ে ভালোবাসাটা গাঢ় হয়। এর পর তো টটেনহামের ফ্যান হয়ে যাই। গ্যারি লিনেকারকে দেখেছি তখন। তার পর তো তাঁর সঙ্গে কাজও করেছি।

বাংলাদেশের খেলাধুলা সম্পর্কে ধারণা আছে?
রেশমিন: খুব বেশি না। শুধু এটুকু জানি, বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট ও ফুটবল দল ভালো করছে। বাংলাদেশের মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। আর ক্রিকেট বলতে সাকিব আল হাসান। একবার বাবা-মাকে টিকিট জোগাড় করে দিতে হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য। তবে যখন বাংলাদেশ আর ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ম্যাচ হয়, তখন কিন্তু আমি বাংলাদেশকেই সাপোর্ট করি। আমার ছেলেমেয়েও আমার সঙ্গে তখন স্লোগান দেয়- ‘কামঅন বাংলাদেশ’ বলে।

বছর চার আগে উয়েফার একটি অনুষ্ঠানে মেসি আর রোনালদোকে পাশে বসিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তখন তো তাদের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মুখ দেখাদেখি বন্ধ প্রায়। সে দিনের সেই মুহূর্তটা একটু যদি শেয়ার করতেন

রেশমিন: মজার ব্যাপার হয়েছিল সেদিন। অনুষ্ঠানের আগের দিন মঞ্চে রিহার্সেল দিয়ে হোটেলে ফিরি। তখন আমার কাছে অনুষ্ঠানের সিটিং প্ল্যানটা আসে। চেক করে দেখি মেসি আর রোনালদোকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। তখনই মজার ব্যাপারটি মাথায় আসে। আমি প্রডিউসারকে বলি- দেখ, তারা দু’জন পাশাপাশি বসেছেন। আমরা কি তাদের নিয়ে কিছু করতে পারি না? একসঙ্গে তাদের দু’জনকে আর কবে এভাবে পাওয়া যাবে, জানি না। প্রডিউসার আমাকে বললেন- দেখ, স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে যদি আমরা কিছু করার চেষ্টা করি, তাহলে প্রথমে উয়েফার অনুমতি নিতে হবে। এর পর দু’জনের ক্লাব জুভেন্টাস ও বার্সেলোনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তারা বোধ হয় কিছু করতে দেবে না। তার চেয়ে তোমার যা ইচ্ছা তাই কর, পরে না হয় দেখা যাবে। এর পর অনুষ্ঠানের দিন আমার কো হোস্ট এসে বললেন, দেখ মেসি-রোনালদো দু’জন সারাক্ষণ কথা বলছেন। আমিও তাকিয়ে দেখি তারা নন-স্টপ কথা বলে যাচ্ছেন। আর তখনই ঠিক করে ফেলি, তাদের দু’জনকেই দু’জনকে নিয়ে কিছু বলতে বলব। তাদের বাইরে থেকে দেখলে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলেও আদতে তারা একজন আরেকজনকে ভীষণভাবে সম্মান করেন। মেসি একটু কম কথা বলেন, তবে রোনালদো ব্রিলিয়ান্ট। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের পর উয়েফা থেকেও আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছিল।

Facebook Comments Box

Posted ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

nykagoj.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

ক্যালেন্ডার

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
সম্পাদক
আফরোজা ইসলাম
কন্ট্রিবিঊটিং এডিটর
মনোয়ারুল ইসলাম
Contact

+1 845-392-8419

E-mail: nykagoj@gmail.com