
রাজনীতি ডেস্ক | বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫ | প্রিন্ট | 98 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অভাবনীয় পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। নতুন এই রাজনৈতিক সংগঠনটি তাদের আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলছে। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এনসিপি নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে, একে তারা সংশোধিত হওয়ার সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন। তাঁর দাবি, এনসিপি রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার বলে অন্য দলগুলো যে সমালোচনা করছে, তা ভুল। জোট গঠন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের অংশীদার যে কোনো দলের সঙ্গে জোট হতে পারে।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহাম্মদ
২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর ঘোষণা ছিল– দেশজুড়ে সাংগঠনিক বিস্তার ঘটানো হবে। সেদিন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বললেন, প্রাথমিক লক্ষ্য নিবন্ধনের শর্ত পূরণ। সাংগঠনিক বিস্তার এবং শর্ত পূরণের কাজটি কীভাবে করছেন?
আখতার হোসেন : এনসিপি আত্মপ্রকাশের মাত্র দুই সপ্তাহ হলো। উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক রয়েছেন। তারা গোটা দেশকে কয়েকটি জোনে ভাগ করেছেন। আগে থেকেই যারা জাতীয় নাগরিক কমিটিতে (জানাক) ছিলেন, যারা এনসিপিতে আসতে আগ্রহী, তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই প্রাথমিক সদস্য ফরম প্রকাশ করা হবে। এর মাধ্যমে নতুনরা দলে আসতে পারবেন।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, তা নির্বাচন কমিশনের পুরোনো আইনে চলছে। এই আইন সংশোধনের জন্য এনসিপি আবেদন করবে নির্বাচন কমিশনে। কিছু কিছু শর্ত গণতন্ত্রমুখী হওয়ার বদলে কোণঠাসা করার মতো হয়েছে। এগুলো সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হবে।
নিবন্ধনের ছোট ছোট শর্ত এনসিপি পূরণ করতে না পারলে জাতীয় নির্বাচনে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে?
আখতার হোসেন : নিবন্ধনের জন্য ২১ জেলায়, ১০০ উপজেলায় কমিটি কার্যালয় থাকার যেসব শর্ত রয়েছে, সেগুলো খুব অল্প সময়ে এনসিপির পক্ষে পূরণ সম্ভব। কারণ, প্রায় ৪৫০ উপজেলা-থানায় আগে থেকেই জানাকের কমিটি রয়েছে। কোথাও কমিটি ২০০ সদস্যের, কোথাও ৩০০ সদস্যের। আরও নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। তাই নিবন্ধনের জন্য যতটা সক্ষমতা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি সক্ষমতা এনসিপির আগে থেকেই আছে। কিন্তু নিবন্ধনের যে আইন রয়েছে, তা গণতান্ত্রিক হওয়া দরকার।
গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব এবং তাদের সংগঠন নিয়ে যে উচ্ছ্বাস-উৎসাহ ছিল, তা গ্রামীণ এলাকায় এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এনসিপির কথা শুনেছে, গ্রামীণ এলাকায় এমন মানুষ খুব বেশি নেই। জানাকের কার্যক্রম দেখেছে, গ্রামাঞ্চলে এমন মানুষ নেই বললে চলে।
এনসিপি কি তাহলে শুধুই ঢাকা এবং সামাজিক মাধ্যমকেন্দ্রিক দল?
আখতার হোসেন : আমরা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃতির লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এটা সত্য, গ্রামীণ পর্যায়ের লোকজনকে দলে আবদ্ধ করতে পারিনি। এ ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের যে একটি দল আত্মপ্রকাশ করেছে, এ ব্যাপারে মানুষের জানাশোনা ও বোঝাপড়া আছে। মানুষ চায় তরুণদের হাত ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হোক। তরুণরা জনগণকে নেতৃত্ব দিক, এই প্রত্যাশা মানুষের রয়েছে। এনসিপির আত্মপ্রকাশের আগে ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ প্রচারাভিযানে প্রায় ২ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল।
২ লাখ মানুষ কিন্তু বাংলাদেশের মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ …
আখতার হোসেন : কোনো রাজনৈতিক দল কিন্তু আত্মপ্রকাশের আগে এত মানুষের মতামত নেয়নি। এনসিপি দলের নাম কর্মসূচি নির্ধারণে যেভাবে মানুষের মতামত নিয়েছে, তা নজিরবিহীন। ২ লাখ সংখ্যাটি অল্প হতে পারে, কিন্তু এতে মানুষের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
মতামত প্রসঙ্গে এলে দলের গঠনতন্ত্র এবং ইশতেহারের কথা আসে। এনসিপির গঠনতন্ত্রে আদর্শ কী হবে– ডান, বাম, মধ্যপন্থি নাকি মধ্য ডান?
আখতার হোসেন : দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডান ও বামের যে বাইনারি রয়েছে, এর বাইরে গিয়ে মধ্যপন্থি রাজনীতি দাঁড় করাতে চাই। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ, আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন, মানবাধিকারকে নিয়ে মধ্যপন্থি দল হতে চাই।
বিএনপিও নিজেদের মধ্যপন্থি দল বলে। সামাজিক মূল্যবোধের কথা বললেন, কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা কী থাকবে এনসিপিতে?
আখতার হোসেন : বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় সম্প্রীতিতে বাস করে। তুলনামূলকভাবে ধর্মীয় উগ্রতা নেই। ধর্মীয় ক্ষেত্রে এনসিপির অবস্থান হলো, মানুষ যেন পূর্ণমাত্রায় ধর্ম পালনের স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। সেটা আমরা নিশ্চিত করার পক্ষে। উগ্রবাদ রোধে কঠোর অবস্থান নিতে চাই।
অনেকে বলছে, এনসিপি মধ্য ডানপন্থি বা প্রো-ইসলামিক পার্টি …
আখতার হোসেন : বাংলাদেশে যত ধর্ম এবং ধর্মগুলোর যত সম্প্রদায় রয়েছে, তাদের সবার মতামতের প্রতি এনসিপি শ্রদ্ধাশীল। সবাই যেন সমান নাগরিক অধিকার পায়, সে ব্যাপারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শ্রদ্ধা এক বিষয় আর সবার মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করা আলাদা।
আখতার হোসেন : এনসিপি যে মধ্যপন্থি অবস্থা নিয়েছে, এতে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকারের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষকে আমরা এনসিপিতে এক করতে পেরেছি।
জনতুষ্টির রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিকে তোষণ বা প্রাধান্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশ বাঙালি ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এনসিপি কি তাদের অনুভূতিকে প্রাধান্য দেবে না?
আখতার হোসেন : এনসিপি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কারও অনুভূতিতেই আঘাত করবে না। একই সঙ্গে ধর্মকে ব্যবহার করে যে উগ্রপন্থা, এনসিপি তার বিরোধী। খুব স্পষ্ট করে বলে আসছি, ডান ও বাম ধারার বাইরে এসে মধ্যপন্থি রাজনীতি করতে চাই।
মধ্যপন্থার সঙ্গে আসে ধর্মনিরপেক্ষতা। এনসিপি কখনও নিজেকে সেক্যুলার দাবি করেনি। রাজনীতির নতুন ধারণায় ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে বহুত্ববাদের কথা আসছে। এনসিপি ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ ও বহুত্ববাদের রাজনীতি করবে?
আখতার হোসেন : বিদ্যমান সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশে ইসলামফোবিয়ার চর্চা হয়েছে। এই শব্দের মধ্য দিয়ে ধর্মের সম্প্রীতির বদলে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। রাজনীতির মাধ্যমে বিভাজন আরও বাড়ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের যে রাজনীতি, এর বাইরে গিয়ে সম্প্রীতির রাজনীতি করতে চাই।
তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ধর্মীয় সম্প্রীতি এনসিপির আদর্শ হবে?
আখতার হোসেন : সম্প্রীতিকেই এনসিপি গুরুত্ব দিচ্ছে।
ছাত্র নেতৃত্ব শুরুতে সব রাজনৈতিক দলের যে শুভকামনা পেয়েছিল, তা আর দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি, জামায়াত, শহুরে মধ্যবিত্তসহ সবাই এনসিপির সমালোচনা করছে। কোথায় এনসিপি দল গঠন ও পরিচালনার টাকা পেয়েছে– এ প্রশ্ন তুলছে। এনসিপি নেতাদের হেলিকপ্টার ব্যবহার, নানা অপকর্মে জড়িত হওয়ার কথা আসছে। এনসিপির এখন বন্ধু কে?
আখতার হোসেন : জুলাই গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসরদের সঙ্গেই এনসিপির বৈরিতার সম্পর্ক রয়েছে। এর বাইরে যারা অভ্যুত্থানের শক্তি, তারা সবাই এনসিপির বন্ধু এবং প্রতিযোগী। রাজনীতিতে সবাই সবার প্রতিযোগী। এই প্রতিযোগিতা যেন হানাহানিতে রূপ না নেয়। ইতিবাচক প্রতিযোগিতার কথা এনসিপি বলছে। বিএনপি, জামায়াত, ডান, বাম সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতার প্রশ্নে। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা রয়েছে, মানুষকে এনসিপিতে যুক্ত করতে। এনসিপির বিরুদ্ধে যে প্রশ্ন উঠছে, সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলো ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছে এনসিপি। এসব সমালোচনা আমাদের সংশোধিত ও পরিশীলিত করবে।
এনসিপিকে কিংস পার্টি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে গড়ে ওঠা দল বলে বিএনপিসহ অনেকে সমালোচনা করছে …
আখতার হোসেন : এনসিপি কোথায় কি বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে? কেউ রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহার করছে– এগুলো ভুল সমালোচনা।
এনসিপি সংস্কারের নামে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায়, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায় বলে সমালোচনা রয়েছে। এনসিপি নির্বাচন কখন চায়?
আখতার হোসেন : এনসিপি গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছে। গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান চাচ্ছে। এর মানে এই নয়, এনসিপি নির্বাচন চায় না।
আপনাদের সাবেক রাজনৈতিক সহকর্মী নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদের নেতারা নিয়মিত এনসিপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছে। বিএনপিও সমালোচনা করছে।
আখতার হোসেন : যারাই সমালোচনা করছে, তারা আলাদা সংগঠন। তারা শত্রু না।
প্রতিযোগীদের সঙ্গে আগামীতে নির্বাচনী জোট দেখা যাবে? জোট হলে বিএনপি না জামায়াতের সঙ্গে হবে? কার সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা বেশি।
আখতার হোসেন : এনসিপি গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছে। নির্বাচন যেভাবেই হোক, জোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিই না। আদর্শ, কর্মসূচি এবং নির্বাচনকালীন প্রেক্ষাপটে যে দলের সঙ্গে এনসিপির অবস্থান সবচেয়ে সংগতিপূর্ণ হবে, তাদের সঙ্গে জোট হলেও হতে পারে। জোট হবে না– এমন সিদ্ধান্ত নেই। হবে এমন সিদ্ধান্তও নেই। কার সঙ্গে জোট হবে স্পষ্ট নয়। কারণ, অনেক দলের সঙ্গে কথা বলছি। নানা মাত্রায় কথা হচ্ছে। নির্বাচনের সময় এলে স্পষ্ট হবে।
Posted ৪:১৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫
nykagoj.com | Stuff Reporter