রবিবার ১৩ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘হামার ছোলেক মারে ফালে দিছে, লাশও পালেম না’

জাতীয় ডেস্ক   |   রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   26 বার পঠিত   |   পড়ুন মিনিটে

‘হামার ছোলেক মারে ফালে দিছে, লাশও পালেম না’

তিন মাস ধরে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না বৃদ্ধা মেরিনা বেগম। কখনও জেগে থাকতে থাকতে ক্লান্ত চোখ বুজে এলে ছোট ছেলে মনিরুজ্জামান মিলনের (৩০) মুখটা ভেসে ওঠে। ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে সন্তানের নাম ধরে কাঁদতে থাকেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের খবরে আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মিলন। এরপর থেকে তাঁর সন্ধান মেলেনি। স্বজনরা ধরেই নিয়েছেন তিনি আর বেঁচে নেই। কিন্তু মেরিনা বেগমের মন মানে না। মোবাইল ফোন বেজে উঠলে ছুটে ধরতে যান। ভাবেন, মিলন কল করেছেন। কিন্তু না; মিলনের কোনো খবর নেই।

ছেলে জীবিত ফিরবেন, এই আশা ছেড়েই দিয়েছেন মেরিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘হামার ছোলেক (ছেলে) মারে ফালে দিছে। ছোলের লাশও পালেম না। ছোলের শেষ মুখটা দেখপার পালেম না।’

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের জোড়গাছা গ্রামের মৃত সুরুজ্জামানের ছেলে মিলন। তারা দুই ভাই ও এক বোন। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর মিলন ঢাকায় মেকানিকের ওপর দুই বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করে ২০১৪ সালে চাকরিতে যোগ দেন। বিয়ে করেন ২০২১ সালে। গত ১৫ জুলাই সাভারের আশুলিয়া ইপিজেডে একটি ডাইং কারখানায় সিনিয়র মেকানিক পদে যোগ দেন তিনি। এর আগে গাজীপুরে কর্মরত ছিলেন। আশুলিয়া থানার বিপরীত পাশে বুড়িবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নেন। ২৬ জুলাই স্ত্রী সুবিতা খাতুন ও ১৪ মাসের কন্যা মানসুরা মারিয়ামকে নিয়ে নতুন বাসায় ওঠেন। মিলনের মা অসুস্থ থাকায় স্ত্রী-সন্তানকে ২৮ জুলাই গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালানোর খবর অন্য সবার মতো মিলনও পান। এরপর আশুলিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। এদিন সকাল ১০টায় স্ত্রী সুবিতা খাতুনকে কল করে বলেছিলেন, ‘অনেকেই আন্দোলন করছে, মারা যাচ্ছে। আমি ঘরে বসে থাকি কেমনে?’

জবাবে সবিতা বলেছিলেন, ‘কিছু হয়ে গেলে তোমার মেয়ের কী হবে?’ পরে বিকেলে মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন মিলন। মেরিনা বেগম বলেন, ‘মিছিলে যাওয়ার আগে ছোলের সাথে ফোনে কথা কছিলাম। তখন ছোল কছিল, মা, শেখ হাসিনা পলে গেছে। রাস্তায় আনন্দ মিছিল হচ্ছে। মিছিলে যামু। হামি কছি, তুই যাসনে বাবা মিছিলত। তারপর বিকাল থাকি ফোন দিলি আর ধরে না।’

বিকেলে মোবাইল ফোনে মিলনের সঙ্গে তার বড় ভাই সামিউল ইসলাম মিল্টনের দুইবার কথা হয়। এদিন আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। অনেকেই নিখোঁজ হন। ৪৬ লাশের মধ্যে আশুলিয়া থানার সামনে একটি পিকআপ ভ্যানে ১১টি লাশে আগুন ধরিয়ে দেয় পুলিশ।

স্বজনরা জানান, ৫ আগস্টের পর মিলনের সন্ধানে হাসপাতাল, ক্লিনিক, মর্গ, থানা, এমন কোনো জায়গা নেই যে খোঁজ করতে বাকি রেখেছেন। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা নিশ্চিত না হলেও স্বজনের ধারণা, পুলিশ গুলি করে হত্যার পর লাশ গুম করে দিয়েছে।

মিছিল থেকে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন মিলন

সুবিতা খাতুন জানান, ৫ আগস্ট বিকেল ৩টায় শেষবারের মতো স্বামীর সঙ্গে তার কথা হয়। মিলন তখন আশুলিয়ায় আনন্দ মিছিলে। অনেক হৈচৈ ও শব্দের কারণে বেশি কথা হয়নি। স্বামীকে সাবধানে থাকার কথা বলেছিলেন সুবিতা। আধাঘণ্টা পর থেকে একাধিকবার কল করলেও মিলন আর ধরেননি। এর আগে ওইদিন দুপুর ২টায় যখন কথা হয় তখন মিলন স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, সকালে তার বাসার সামনে প্রচুর গোলাগুলি হয়েছে। একজন মারা গেছে।

টঙ্গী সরকারি কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুবিতা বলেন, ‘সেদিন যদি অনুরোধ করে মিছিল থেকে বাসায় ফিরে যেতে বলতাম, তাহলে তাকে হারাতে হতো না। বাচ্চাটা সব সময় বাবা বাবা করে। তার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার স্বামীর কী পরিণতি হয়েছে, এটা জানার অধিকার আমার আছে। তাকে খুঁজে বের করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করছি। না পাওয়া গেলে আমার স্বামীর শহীদের স্বীকৃতি চাই।’

মিলনের খোঁজে হাসপাতাল-মর্গে ঘুরেছেন ভাই

মিলনের বড় ভাই কলেজশিক্ষক সামিউল ইসলাম মিল্টন জানান, ঘটনার দিন রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত তার মোবাইল ফোনে কল গেছে। এরপর ফোন বন্ধ পাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ে। ভাইয়ের খোঁজে পরদিন বগুড়া থেকে ঢাকায় রওনা দেন তিনি। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাস থেকে আশুলিয়া থানার সামনের সড়কে নামেন। ফুট ওভারব্রিজের নিচে পিকআপে ছয়টি লাশ দেখতে পান। লাশগুলো চেনা যাচ্ছিল না। সামিউলের সঙ্গে তিন আত্মীয় ছিলেন। একটা লাশ উপুড় হয়ে থাকায় সেটি মিলন বলে ধারণা করেন তারা। পরে নিশ্চিত হন, সেটি মিলন নয়। পর্যায়ক্রমে তারা ছোটেন সাভারের পাঁচটি হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও মিলনকে পাওয়া যায়নি।

৭ আগস্ট আবার ভাইয়ের খোঁজে বের হন সামিউল। যান রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে। এসব হাসপাতালের সব ওয়ার্ড ও মর্গে খুঁজেও মিলনের সন্ধান পাননি। পরে কাকরাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও মিলনের সন্ধান করেন স্বজনরা।

জিডি নেয়নি পুলিশ

মিলনের সন্ধান না পেয়ে ১১ ও ২১ আগস্ট আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যান সুবিতা ও সামিউল। থানা পুলিশ তাদের লিখিত অভিযোগপত্র জমা নিলেও সেটি জিডি বা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়নি।

সামিউল বলেন, ২১ আগস্ট আশুলিয়া থানায় লিখিত অভিযোগপত্র জমা নেওয়ার পর জানিয়ে দেওয়া হয়, এক পুলিশ কর্মকর্তা যোগাযোগ করবেন। কিন্তু জিডি নম্বর বা সিল-স্বাক্ষর কিছুই দেয়নি। পরবর্তী সময়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগও করেনি। ১১ আগস্ট সুবিতা আশুলিয়া থানায় জিডি করতে গেলে একইভাবে অভিযোগপত্র জমা নেয় পুলিশ, কিন্তু জিডি নথিভুক্ত করেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তখন আশুলিয়া থানায় ওসি ছিলেন এ এফ এম সায়েদ। ৫ আগস্টের পর তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়ায় তিনি আত্মগোপনে আছেন।

সন্ধান দেওয়ার নামে প্রতারণা

মিলন নিখোঁজের খবর ছড়িয়ে পড়লে অপরিচিত ব্যক্তিরা তার স্বজনের কাছ থেকে সন্ধান দেওয়ার নামে ১৭ হাজার ৬০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। স্বজনরা জানান, ৬ আগস্ট অজ্ঞাত এক ব্যক্তি সুবিতাকে ফোন করে জানান, মিলনকে একটি গ্রুপ আটকে রেখেছে। ২০ হাজার টাকায় মুক্তি মিলবে। বিকাশে ৮ হাজার ৮০০ টাকা দেওয়ার পর ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ১১ আগস্ট আরেক ব্যক্তি একইভাবে প্রতারণা করে আরও ৮ হাজার ৮০০ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে স্বজনরা বুঝতে পারেন, প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বগুড়ার অন্যতম সমন্বয়ক সাকিব খান বলেন, নিখোঁজের বিষয়টি আমরা জানি। এ ব্যাপারে ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমরা কথা বলব।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান বলেন, আমার দিক থেকে পরিবারটিকে সহায়তা করব।

Facebook Comments Box

Posted ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪

nykagoj.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
সম্পাদক
আফরোজা ইসলাম
কন্ট্রিবিঊটিং এডিটর
মনোয়ারুল ইসলাম
Contact

+1 845-392-8419

E-mail: nykagoj@gmail.com