জাতীয় ডেস্ক | বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 16 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরল বৈঠক নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। এতে জানানো হয়, বৈঠকে বাইডেন বলেছেন, বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে (বাংলাদেশ সময় রাত) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে দুই নেতার মধ্যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। পরে বৈঠক বিষয়ে একটি বিবৃতি (রিডআউট) প্রকাশ করে হোয়াইট হাউস। এতে বলা হয়, মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ায় তাঁকে অভিনন্দন জানাতে গতকাল তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বৈঠকে উভয় নেতা যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের বিষয়টি উল্লেখ করেন। বলেন, এই সম্পর্কের মূলে রয়েছে পারস্পরিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের মধ্যকার শক্তিশালী বন্ধন।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে আরও সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে এ বৈঠক হয় বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ম্যানহাটানের
গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন–
১. জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে সব পক্ষকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করতে পারেন। সম্মেলনে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা এবং উদ্ভাবনী ও অগ্রসর উপায়ে পরামর্শ দেওয়া উচিত।
২. জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানকে শক্তিশালী করা দরকার। স্লাইডিং ফান্ডিং পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রিসোর্স বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে আরও রাজনৈতিক চাপ দিতে হবে।
৩. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যামূলক অপরাধ মোকাবিলায় ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির ব্যবস্থাকে গুরুত্ব সহকারে সমর্থন করা।
বৈঠকে মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত জুলি বিশপ, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এতে ড. ইউনূস বলেন, গত দুই মাসে আরও ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আতিথেয়তা সত্ত্বেও একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ব্যয়ের ক্ষেত্রে এত বেশি খরচ হয়ে চলেছে; এগুলো আমাদের জন্য প্রথাগত ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি। আমাদের নিজস্ব উন্নয়ন অনেকটাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। স্পষ্টতই বাংলাদেশ তার ধৈর্যসীমায় পৌঁছেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যতই মানবিক দিক বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে নিয়োজিত থাকুক, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান।
সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টা মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে পৃথক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নানা স্তরে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা ভালো উপায় হতে পারে বলে উল্লেখ করে পাকিস্তানের সমর্থন চেয়েছেন। শাহবাজ শরিফ এ উদ্যোগের জন্য তাঁর সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি আঞ্চলিক এ ফোরামকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বুধবার সকালে (বাংলাদেশ সময় রাত) ড. ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে দুই দেশের শীর্ষ নেতারা এ বৈঠক করেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, বৈঠকে শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় খোলা উচিত। আমাদের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা খুবই জরুরি।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের বস্ত্র ও চামড়া খাতে বিনিয়োগের জন্য তাঁর দেশের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দুই দেশের মধ্যে যুব কর্মসূচি বিনিময়ের প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া দুই শীর্ষ নেতা দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনার যৌথ কমিশন আবার শুরু করার বিষয়ে আলোচনা করেন।
সুযোগ হাতছাড়া করব না
সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশের নতুন যাত্রায় বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতা কামনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। নিউইয়র্ক সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ হাতছাড়া করব না। আমাদের শুরুটা ভালো করতে হবে। এটি বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সমর্থন প্রয়োজন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্যপদ লাভের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আয়োজিত এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে।
সংবর্ধনা আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আরও ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়াজ হামিদুল্লাহ, উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর।
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আলোকচিত্রী, লেখক, কিউরেটর ও অ্যাকটিভিস্ট শহিদুল আলম শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। যারা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, আমরা তাদের হতাশ করতে চাই না।’ সংস্কারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পর নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে ছাত্ররা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর। এটা বাংলাদেশের তরুণরাই নিয়ে এসেছে।’ এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেওয়া এবং সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানায় জাতিসংঘ।
ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে আমার শুভেচ্ছা জানাই সাধারণ পরিষদে যোগদানের জন্য। এ বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ৫০ বছরের সম্পর্ক উদযাপন করছে।
মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদরদপ্তরে এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস। এ ছাড়া সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গেও ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ২০২৪-এর বৈঠকে মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছিলেন ড. ইউনূস।
অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর
ছাত্র-জনতার আন্দোলন খুব সুশৃঙ্খলভাবে চালিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
জ্যাকসন হাইটসে এ অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বলেন, কিছুই হঠাৎ হয়নি। বাংলাদেশের এই তরুণরাই নতুন বাংলাদেশ গড়বে।
অনুষ্ঠানে বিল ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কাহিনি এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নানা বিষয় তুলে ধরেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে দীর্ঘদিনের বন্ধু বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে সফরসঙ্গীদের তিনজনকে পরিচয় করিয়ে দেন ড. ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলমকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের কারিগর হিসেবে উল্লেখ করেন। কথা বলার এক পর্যায়ে মাহফুজকে সামনে এগিয়ে দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর মাহফুজ। যদিও মাহফুজ সব সময় বলে, সে একা নয়, আরও অনেকে আছে। যদিও সে গণঅভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর হিসেবে পরিচিত।’
ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘এটি (ছাত্র আন্দোলন) খুব গোছানো ছিল। এমনকি লোকজন জানত না, কারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই আপনি একজনকে ধরে ফেলে বলতে পারবেন না, ঠিক আছে, আন্দোলন শেষ। তারা যেভাবে কথা বলেছেন, তা সারাবিশ্বের তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন অনুষ্ঠানের শুরুতেই অধ্যাপক ইউনূসকে বাংলাদেশের তরুণ নাগরিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণকারী নেতা বলে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে দুই নেতা কোলাকুলি করেন।
Posted ৪:০০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
nykagoj.com | Stuff Reporter