
জাতীয় ডেস্ক | বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট ২০২৪ | প্রিন্ট | 154 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রচলিত আদালতের বদলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্ভব কিনা, তা নিয়ে আইনজ্ঞদের দ্বিমত থাকলেও গতকাল বুধবার হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে শেখ হাসিনা সরকার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ শতাধিক স্বাধীনতাবিরোধীকে সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল। এই প্রথম স্বাধীনতাবিরোধী নয়, এমন কারও বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ পড়ল।
গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যেসব গণহত্যা, হত্যাকাণ্ড ও গুলির ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হতে পারে। এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি, যারা আদেশ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবাইকে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।
তবে ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত সমকালকে বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রবাসী সরকার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। আইন হয় ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই। আইনটির উদ্দেশ্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা। তাই ট্রাইব্যুনালে বর্তমান সময়ে সংঘটিত অপরাধের বিচার হতে পারে না। ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার জন্য দণ্ডবিধি এবং সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য নয়। শুধু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্দেশ্যে এ বিধান রাখা হয়েছে। এসব কারণে ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচারের যৌক্তিকতা নেই।
তবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ দিয়েছেন ভিন্ন মত। তিনি সমকালকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে ৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে কী কী অপরাধের বিচার করা যাবে। এ অনুচ্ছেদের ২(ক) ধারায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক, বর্ণ বিদ্বেষ, জাতিগত কিংবা ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে কোনো বেসামরিক নাগরিকের ওপর হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, গুম, অপহরণ, নির্যাতনসহ অন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে। অপরাধ কখন সংঘটিত হয়েছে, তা আইনে বলা নেই। ফলে যে কোনো সময়ের মানবত বিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালে সম্ভব।
শেখ হাসিনা সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, হত্যার নির্দেশ ও পরিকল্পনাকারী আখ্যা দিয়ে গতকালই তিনিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করা হয়।
সিয়াম হত্যায় ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা বুলবুল কবিরের পক্ষে গতকাল দুপুরে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আবেদন দাখিল করেন আইনজীবী গাজী এমএইচ তানিম। ব্যক্তির পাশাপাশি দল এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানানো হয়েছে।
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের প্রাক্কালে ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ সিয়াম চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৭ আগস্ট মারা যায়। আরজিতে সিয়ামসহ গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন দমনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানিয়েছে, সব কিছু খতিয়ে দেখে সত্যতা পেলে তদন্ত সংস্থা মামলার সুপারিশ করবে। তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আতাউর রহমান সমকালকে বলেন, ‘অভিযোগটি নথিভুক্ত করেছি। এর মাধ্যমে তদন্ত শুরু হলো। তদন্ত শেষে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অফিসে প্রতিবেদন জমা হবে।’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুই মামলা
আইনজীবী মাসুদ রানাকে অপহরণ ও নির্যাতন এবং কলেজ শিক্ষার্থী রাজন হত্যার অভিযোগে গতকাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে আলাদা দুটি বেঞ্চে আরও দুটি মামলা হয়েছে।
দুই বাদীর জবানবন্দি নিয়ে মহানগর হাকিম আবেদন দুটি এজাহার (এফআইআর) হিসেবে গ্রহণ করতে থানা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এ নিয়ে গত দুই দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চারটি মামলা ও অভিযোগ দায়ের হলো।
রাজন হত্যার অভিযোগ
শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের ২৪ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে তাঁর ভাই রাজিব মামলার আবেদন করেন। পরে হাকিম আহম্মেদ হুমায়ুন কবির বাদীর জবানবন্দি নিয়ে কাফরুল থানার ওসিকে মামলাটি এজাহার (এফআইআর) হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন– সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ড. হাছান মাহমুদ, মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার ও মাইনুল হোসেন খান নিখিল, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নান কচি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হক সাচ্চু, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ নেতা সালামত উল্লাহ সাগর ও দীপঙ্কর বাহার দীপ্ত।
এজাহার থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতা সাগর ও দীপ্তর সরাসরি অংশগ্রহণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ অজ্ঞাতনামা ৫০০ থেকে ৬০০ জন গণঅভ্যুত্থানকারীদের ওপর ১৯ জুলাই বিকেল ৩টার দিকে নির্বিচারে গুলি করে। রাজন মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে মিরপুর ৬ নম্বরের ডা. আজমল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া আরও অনেক ছাত্র গুলিবিদ্ধ ও নিহত হয়।
আইনজীবী নির্যাতনের মামলা
৯ বছর আগে অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা। ঢাকা মহানগর হাকিম ফারজানা শাকিল সুমু চৌধুরী বাদীর জবানবন্দি নেওয়ার পর অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ এবং র্যাবের অজ্ঞাতপরিচয় ২৫ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে বাদী ও তাঁর বন্ধু আশরাফুল ইসলাম রিঙ্কুকে উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর সড়কে ইসমাইল গ্যালারির সামনে থেকে র্যাবের স্টিকারযুক্ত গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাদের হাত পিছমোড়া করে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। বাদীর ফোন এবং মানিব্যাগ নিয়ে নেয় গাড়িতে থাকা লোকজন। বাদীকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এ সময় তাঁর চিৎকার যেন বাইরে না যায়, সে জন্য গাড়িতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়।
এপর আশরাফুল ইসলাম রিঙ্কুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে সোহেল রানাকে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে অত্যাচার করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বাদীর অভিযোগ তাঁকে ১৮৩ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
সায়েদ হত্যা মামলার প্রতিবেদন ১৫ সেপ্টেম্বর
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানি আবু সায়েদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে মামলায় শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের দুই মন্ত্রীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন ঢাকা মহানগর হাকিম জাকি আল ফারাবি। বাদীর আইনজীবী মো. মামুন মিয়া এ তথ্য জানান।
গত মঙ্গলবার আদালতে সায়েদ হত্যা মামলার আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এজাহার গ্রহণ করে গতকাল মোহাম্মদপুর থানা সেটি আদালতে পাঠিয়েছে।
Posted ৩:৪৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট ২০২৪
nykagoj.com | Stuff Reporter