রবিবার ১৩ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খামারি-মন্ত্রণালয় মিলেমিশে ব্রাহমা জালিয়াতি

জাতীয় ডেস্ক   |   বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   85 বার পঠিত   |   পড়ুন মিনিটে

খামারি-মন্ত্রণালয় মিলেমিশে ব্রাহমা জালিয়াতি

কোরবানির আগে কোটি টাকার ‘বংশমর্যাদাপূর্ণ’ ব্রাহমা প্রজাতির গরু নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে। সেই শোরগোল থামেনি এখনও। কোটি টাকার সেই গরু নিয়ে চলছে নানা ব্যবচ্ছেদ। এর মধ্যেই আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে–ব্রাহমা গরু কি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ? আর নিষিদ্ধ হলে সে গরু কীভাবে সরকারি খামার থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন খামারে গেল। আর তিন বছর আগে জব্দ করা ব্রাহমা গরুই কেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে কেজি দরে বেচতে হবে। কেনইবা ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি না করে তা খামারেই থেকে গেল। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে বেশকিছু তথ্য। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) অনুসন্ধানে নেমেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ব্রাহমা জাতের ১৮ গরু আমদানি করে সাদিক অ্যাগ্রো। কাস্টমস বিভাগ বিমানবন্দরে সে গরু জব্দ করে সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে রাখে। এর মধ্যে তিনটি গরু মারা যায়। পরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গত ৩ মার্চ বাকি ১৫ ব্রাহমা গরু ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রির অনুমতি দেয়। সেখানেই শুরু জালিয়াতি। এসব গরু সাদিক অ্যাগ্রো নিলামে কিনে নিলেও অভিযোগ আছে, কিছু গরু ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করেনি। এর বদলে অন্য জাতের গরু কেজি দরে সুলভমূল্যে বিক্রি করা হয়। আর এ অনিয়মের সুযোগ করে দিয়েছিল খোদ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। কারণ ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করেছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর। মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ, জবাই, বিক্রিসহ সবকিছু তদারকি করেছে তারা। এ জালিয়াতির খবর চাউর হওয়ার পরও মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অনিয়মের দায় এড়াতে পারে না মন্ত্রণালয়। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কেই পরিষ্কার করতে হবে।
যেভাবে অনিয়ম কাস্টমস ১৮ গরু জব্দ করার পর সাদিক অ্যাগ্রো উচ্চ আদালতে রিট করেছিল। তবে উচ্চ আদালতের রায় তাদের বিপক্ষে যায়। এর পর থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সাভারেই গরুগুলো ছিল। হঠাৎ গত মার্চে সেই ব্রাহমা ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে বেচার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। গত ৩ মার্চ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. এসএম যোবায়দুল কবির স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বলা হয়, ‘সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে পালিত ১৫ ব্রাহমা গরুসহ প্রজনন অনুপযোগী ১৬৮টি মাংস খাওয়া উপযোগী গবাদিপশু কালিং (বাছাই কমিটি) কর্তৃক নির্ধারিত বুকভ্যালু এবং ভ্যাট ও উৎস কর পরিশোধ সাপেক্ষে ভ্রাম্যমাণ বিক্রিয় কেন্দ্রের মাধ্যমে নিলামে বিক্রয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান করা হলো।’

গত ১০ মার্চ রাজধানীর ৩০ স্থানে ভ্রাম্যমাণ গরুর মাংস বিক্রির কার্যক্রম উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান। পুরো রোজাজুড়ে চলে গরুর মাংস বিক্রির কার্যক্রম। এ সময় প্রতিটি গাড়িতে তদারকির জন্য অধিদপ্তরের একজন করে কর্মকর্তাও ছিলেন। এর পরও ব্রাহমা নিয়ে অনিয়মের ঘটনা ঘটে যায়।

কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের পরিচালক ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্রাহমা গরু আমরা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করেছি। পরবর্তী সময়ে কী হয়েছে, তা আমি বলতে পারব না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্রাহমা গরু ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রির দরকারই ছিল না। গবেষণার জন্য সরকারি খামারে এ গরু রাখা যেত। কারণ দেশে মাংসের উৎপাদন বাড়াতে ব্রাহমা পালন সম্প্রসারণে এর আগে সরকার বেশকিছু প্রকল্পও নিয়েছিল। কিন্তু বাড়তি সুবিধা নিয়েই সরকারি খামার থেকে ব্রাহমা ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রির নাম করে সাদিক অ্যাগ্রোসহ খামারিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ অপকর্মে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের যোগসাজশ ছিল। ওপরের মহলের নির্দেশে এ ঘটনা হয়েছে।

আরেক কর্মকর্তা বলেন, গত ১৮ ও ১৯ এপ্রিল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠে প্রাণিসম্পদ মেলায় সাদিক অ্যাগ্রো কোটি টাকার একটি ব্রাহমা গরু প্রদর্শন করে। অন্য অনেক খামারিও তাদের স্টলে ব্রাহমা গরু তোলেন। তখন মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখেও রহস্যজনক কারণে এড়িয়ে যান।

এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ব্রাহমা বিক্রির সব প্রক্রিয়া আগের মহাপরিচালক করে গেছেন। সবাই এটি জানত। এর পর যা করা হয়েছে, সব আইন মেনেই করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী মো. ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছ থেকে কিনলেও শর্তে এমন কিছু উল্লেখ ছিল না যে ব্রাহমা গরু মাংস হিসেবেই বিক্রি করতে হবে।
ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে ব্রাহমা গরু আনার নির্দেশনা, নিলাম ও বিক্রয় থেকে শুরু করে সব কিছুই জানত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ব্রাহমা নিয়ে মাতামাতি হলেও এ নিয়ে মন্ত্রণালয় চুপ। গতকাল একাধিক কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানতে ফোন করা হলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমানকে এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

ব্রাহমা নিয়ে আতঙ্ক
২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্রাহমা গরু পালনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কয়েক দফায় শতকোটি টাকা খরচ করে। প্রথমে বিফ ক্যাটেল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে ১১ উপজেলায় তিন বছরের জন্য পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয়। পরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ৬০ হাজার শুক্রাণু এনে দেশি গাভীতে ঘটানো হয় প্রজনন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮ জেলার ১৮৫ উপজেলায় ব্রাহমার বিস্তার ঘটানো হয়। এ ধারাবাহিকতায় এখনও কিছু খামারি ব্রাহমা জাতের গরু পালন করছে। সম্প্রতি দেশজুড়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে মাংস উৎপাদনকারী গরুর জাত ব্রাহমা। আর আতঙ্কে আছেন ব্রাহমা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত খামারি। জানা গেছে, এখনও দেশের শতাধিক খামারে এ জাতের গরু লালন-পালন হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো আইনেই ব্রাহমা গরু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। তবে আমদানিতে কঠোরতা আছে। নিষিদ্ধ না হলে কেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এ জাতকে- এর জবাবে ডা. রেয়াজুল বলেন, দেশি গাভীতে ব্রাহমার শুক্রাণু দিয়ে প্রজনন ঘটানো হলে যেসব ফিমেইল ক্যাটল জন্ম নেয়, সেগুলো থেকে কোনো দুধ পাওয়া যায় না। এখানেই দুধের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে সররকার প্রকল্প থেকেও সরে আসে। দুধও দেবে, মাংসও দেবে এমন জাতের গরু চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০ থেকে ২৪ মাসে একটি দেশি গরুর মাংস উৎপাদন ক্ষমতা যেখানে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ কেজি; সেখানে ব্রাহমা থেকে পাওয়া যায় ১০ গুণ বা তারও বেশি। এর আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০টি ব্রাহমা গরু আমদানি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেইরি সান প্রাইভেট লিমিটেড। প্রথমে বাজেয়াপ্ত ও পরে সেটি খালাস করা হয়। আমদানিকারক বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে যান। হাইকোর্ট ‘আমদানি নিষিদ্ধ নয়’ বলে আদেশ দেন।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খামারিকে স্বপ্ন দেখিয়ে কার স্বার্থে আবার প্রকল্প বন্ধ করা হলো, সেটিও খোঁজা দরকার। প্রকল্পের অধীনে ছড়িয়ে পড়া ব্রাহমা গরুর ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে প্রাণিসম্পদ খাতে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তা ঠেকানো না গেলে কয়েক বছরের মধ্যেই বিপর্যয় নামতে পারে। এতে কমতে পারে সার্বিক মাংস উৎপাদন।

Facebook Comments Box

Posted ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪

nykagoj.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
সম্পাদক
আফরোজা ইসলাম
কন্ট্রিবিঊটিং এডিটর
মনোয়ারুল ইসলাম
Contact

+1 845-392-8419

E-mail: nykagoj@gmail.com