
ডেস্ক রিপোর্ট | শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট | 309 বার পঠিত
ছোটকালে কবিতা পড়েছি ‘ঝড়ের দিনে মামার বাড়ি আম কুঁড়াতে সুখ,পাঁকা আমের মধুর রসে রঙ্গিন করি মুখ’।গরমকালে মামার বাড়িতে আম কুঁড়াতে যে সুখ পাওয়া যেতো,তেমনি শীতকালেও নানা -দাদার বাড়িতে পিঠা খাওয়ার সুখটাও কম ছিল না । নানান রকম পিঠা খাওয়া এবং তা এক প্রকার উৎসবে পরিনত হতো ।গ্রাম অঞ্চলে পৌষমাসে নতুন চালের নানান রকম পিঠার বর্ণনা নানাভাবে বর্নিত আছে ।
‘পৌষ মাসে পিঠা পার্বন,পিঠা খাওয়ার ধুম।রাত্রি জেগে বানায় পিঠা ,নস্ট করে ঘুম’ ।গ্রাম অঞ্চলে পৌষমাসে বাড়িতে বাড়িতে ঢেঁকির চালের গুঁড়া করার আওয়াজ পাওয়া যেত।ঢেঁকির আওয়াজ নিয়ে সুন্দর ছন্দের সৃষ্টি হয়েছে ।‘ঢেঁকি নাচে ধাপুর ধুপুর ,নতুন চালের পিঠার ধুম’।আমরা যারা শহরকেন্দ্রীক গ্রাম বা মফস্বলে গেলে বিশেষ করে শীতের সময় মনে মনে আশায় থাকি পিঠা খাওয়ার।আমার বড় আপার শ্বশুরবাড়ি যশোর ।যশোরে খেঁজুর গুড়ের তুলনা নেই।সেখানে যাওয়া হতো প্রায় এবং আমার একটু বেশী।বিয়ের আগ পর্যন্ত আপার ভ্রমণের সঙ্গী আমি ছিলাম ।খাল্লাম্মা মানে আপার শ্বাশুরী কেমন করে যেন ঝটপট তেলের পিঠা বানিয়ে ফেলতেন।সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম খেঁজুরের রসে ভিজানো চিতুই পিঠা,নারকেলের পিঠা যেটা ভাজা বা সেদ্ধ দুরকমই রেডি।খুব ভোরবেলায় উনি বানিয়ে রেডি করে রাখতেন।পরম আনন্দের সাথে ভক্ষণ করতাম।গ্রামের প্রতি ঘরেই মনে হয় চালের গুঁড়া ,গুড় তাও আবার খেঁজুরের গুড় মওজুত থাকে ।আজ খাল্লাম্মা পৃথিবীতে নেই ।আল্লাহ্ উনাকে ওপারে ভালো রাখুন ।নব্বই দশকে শহরের বাড়িগুলোতে পিঠা বানানো হতো না বললেই চলে ।তবে ইদানীংকালে এর প্রবনতা বেশ লক্ষ্য করা যায় ।ব্যাপক আকারে অনেক জায়গাতেই পিঠা উৎসব হচ্ছে ।আমার মা কে দেখতাম শহরের পরিবেশেও প্রায় সবরকমের পিঠাই বানাতেন ।শীতের সময় একরকম পিঠার কথা মনে পড়লে আজও হাসি ,দুঃখ দুটোই অনুভব করি।সেমাই পিঠা,যেটা কি না চালের গুঁড়া দিয়ে বানানো হতো ।আট ভাই -বোনের ছোট আমরা তিনজন চালের আটা দিয়ে আমাদের মনের মতো জিনিসটি তৈরী করতাম।যেমন ফুল ,বল,পাখী,ঘোড়া ইত্যাদি ।রাত্রে তৈরী হতো কিন্তু খেতে পেতাম সকালের নাস্তা হিসেবে মুড়ি দিয়ে তাও আবার পাড়ার সব বাসায় দিয়ে আসার পর।মা কোন জিনিস বানালে বা রান্না করলেও পাড়ায় বিলি করতেন।ভাগে কম পরতো বলে রাগও করতাম।যা হোক অনেক সময় লুকিয়েও মা কে দিতে দেখেছি ।তিন ভাই -বোন মিলে ছুটতে ছুটতে পাড়ার সব বাসায় দিয়ে আসতাম। তার পর উৎফুল্ল চিত্রে সেমাই পিঠার প্লেটটি হাতে নিতাম।খাওয়ার চেয়ে বেশী আগ্রহ দেখার কার পাতে কার তৈরী করা ডিজাইনটি পরেছে । তা নিয়ে হৈচৈ, এই যে আমি বানিয়েছি, ভাই বলে উঠল দেখ তুই বানিয়েছিস এইটা ,আরেক বোন অন্য কিছু বলে চিৎকার করে উঠতো।মা তখন বকা দিয়ে বলতেন,খাওয়ার সময় এতো কথা বলতে হয় না চুপ করে খা।সে কি মজার দিন কোথায় যেন হারিয়ে গেল ।অতীতের দিনগুলো ফিরে পাবো না,কিন্তু স্মৃতির কোঠায় জমা হয়ে আছে ।আর এই জমা হওয়া স্মৃতিগুলোই ব্যক্ত করতে পারছি কলম ধরার পর ।সেইজন্য বড় ভাইকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাই (আমেরিকা ভ্রমণ মানবতা ও আত্মোপলব্ধি ) বইটির জন্যই আমার আত্মপ্রকাশ।শুনেছি প্রচারেই প্রসার ঘটে ।আমি প্রচারবিমুখ।কিছু কিছু ঘটনা বা স্মৃতি প্রচারে আত্মোতৃপ্তি অনুভূত হয় যা কি না দমিয়ে রাখা যায় না ।আবারও সেই পিঠাতে ফিরে যায় ।বাসায় সিদ্ধ বা ভাপ দেয়া নারকেলের পিঠা বানালেই কিছু না কিছু ঘটনা ঘটে যেতো।এটা দূর্ঘটনা বা কুসংস্কার যেটাই বলা হোক না কেন আকস্মিকভাবে সেটা ঘটতো।দুভাগ্যক্রমে সেটা আর খাওয়া বা ভাগ্যে হতো না এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে মা এই পিঠা বানানোই বন্ধ করে দেন।বড় আপা তার বাসায় পিঠাটি বানিয়ে আমাদের খাওয়াতেন।সেই বড় আপাও ৪৫ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী।মাও পৃথিবীতে নেই ,আমিও প্রায় ২৩ বছর আমেরিকায় প্রবাসী হয়ে আছি ।২০০০ সালে আমেরিকার মাটিতে পা দেয়া ।সেই সময় পিঠা উৎসব ব্যাপক আকারে দেখা যায়নি।চার বছর অবস্থানের পর নিউইয়র্ক থেকে ৭০মাইল দূরে যেতে হয়েছিল ।১২ বছর পর আবারও নিউইয়র্ক সিটিতে ফিরে আসা।নিউইয়র্ক সিটির মজার একটা বৈশিষ্ট্য (ঐ ছুঁরি তোর বিয়ে লেগেছে )র মতো ।বাঙ্গালী কমিউনিটিতে নানান জেলা সমিতি আছে , যেমন ফরিদপুর জেলা সমিতি,জামালপুর জেলা সমিতি আরও অনেক ।এগুলো আবার দুই তিন ভাগে বিভক্ত ।প্রত্যেকটি জেলাতে কম বেশী ভাগ আছে ।নিউইয়র্কে কিছুদিন আগে জন্মদিনের ধুম ছিল ,ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হয়েছে পিঠা উৎসব ।মার্চেও তা অব্যাহত আছে ।পিঠা উৎসবের সাথে বসন্তকে যোগ করা হয়েছে ।কিছু কিছু সংগঠনে পিঠা উৎসবে যোগ দিয়েছি আর কিছুটাতে দিতে পারিনি ।
প্রবাসজীবন যাত্রিক জীবন।এই যাত্রিক জীবনেও যে কত সুন্দরভাবে পিঠা উৎসব হতে পারে ভাবা যায় না ।ব্যস্ততার মধ্যেও সুন্দর সুন্দর পিঠা বানানো,শুধু তাই নয়,বসন্তের সাজে তা উপস্থাপন করা সত্যি অবাক করার মতো ।বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা,কৃ্ষ্ণচূড়া গাছ নেই তাতে কি ?এ যেন বাহিরে ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত ।ফাগুনের পিঠা উৎসবের রমণীদের সুন্দর সাজ দেখে কোন গায়ক (বাসন্তী রংয়ের শাড়ী পড়ে ললনারা মেলায় যাইরে না বলে বলতেন বাসন্তী রংয়ের শাড়ী পড়ে ললনারা পিঠা উৎসবে যাইরে )।সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি মিলে যে পিঠা উৎসবটি ছিল ,ডাবের পানির বরফি বা যে নামই দেয়া হোক না কেন প্রশংসা একটু পেয়েছিলাম ।প্রথম আলোর লিটন ভাই বলেই ফেললেন,ভাবী নতুন জিনিস খেলাম।শুনে ভালো লেগেছিল।প্রশংসা সবারই ভালো লাগে কি বলেন?তেলের পিঠাও সুন্দর বানাতে পারি যা আগে পারতাম না ।কর্তা একদিন বলেই বসলেন তুমিতো ব্যবসা করতে পারো।থাক নিজের আর গুণকীর্তন নয়।পিঠা উৎসবগুলোতে গেলে মনে হয় বিদেশের মাটিতে দেশীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখার কি আপ্রাণ চেস্টা ।গর্বে বুক ভরে যায় –—
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে এই প্রবাদ বাক্যটিকে সত্য বলে মনে হয় । (নিউইয়র্ক, ১১ মার্চ ২০২৩)
Posted ১১:৪৪ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩
nykagoj.com | Monwarul Islam