জাতীয় ডেস্ক | বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ | প্রিন্ট | 6 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) মতো আইনের সংস্কারে জোর দিয়েছেন ঢাকা সফররত জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। দুই দিনের ঢাকা সফরে অতীতের মতো প্রতিহিংসার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সংখ্যালঘুসহ সবাইকে সমাজ গঠনে কাজে লাগিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার যাতে মানবাধিকার মানদণ্ড অনুসরণ করে করা হয়, সে বার্তাই দিয়ে গেছেন তিনি।
গতকাল বুধবার ঢাকা সফরের শেষ দিনে প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে গিয়েছিলেন জাতীয় অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। আজ ভোরে জাতিসংঘ মানবাধিকারপ্রধানের ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি এবং ছাত্রলীগকে সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ সৃষ্টি হবে– এ প্রশ্নের উত্তরে ভলকার তুর্ক বলেন, বাংলাদেশে যে ক্ষত হয়েছে, তা পূরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ সৃষ্টিতে তার প্রক্রিয়া আসতে হবে অভ্যন্তরীণভাবে। আর এর জন্য দরকার জবাবদিহি বা ন্যায়বিচারের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। আর অতীতের পুনরাবৃত্তি করা যাবে না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোকে মানবাধিকার চর্চা করতে হবে।
সন্ত্রাস দমন নিয়ে তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমন আইন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, আর এর পরিণতি আমরা দেখেছি। যেভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক মতের অমিল ছিল। যেমন নেলসন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসী হিসেবে এক পক্ষ চিহ্নিত করেছিল। অনেক সময় ভিন্নমত দমনে সন্ত্রাস দমন বিষয়টি ব্যবহার করা হয়।
৫ আগস্টের আগের ও পরের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করলে কমিশনার বলেন, এর আগে বাংলাদেশে সফর করেছি জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হয়ে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণে অবশ্যই অনেক বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। এখানে আলোচনা ও বিতর্ক দেখা যায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আমি আশা করি, এ পরিবর্তনে জাতিসংঘ যাতে সহযোগিতা করতে পারে।
বিগত সরকারের সমর্থকদের গণধোলাইয়ের মাধ্যমে হত্যাকে কীভাবে দেখেন– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, যেই সহিংসতা করুক না কেন, তা তদন্তের দাবি রাখে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে জানতে চাইলে ভলকার তুর্ক বলেন, মানবাধিকার নিয়ে বেশ কিছু ভুল তথ্য রয়েছে। কেউ এটিকে পশ্চিমা তত্ত্ব হিসেবে দেখে, আবার কেউ এটিকে দেখে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে। আবার কেউ এটিকে চাপিয়ে দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখে। মানবাধিকার বিশ্বের একটি পক্ষের কোনো বিষয় নয়, এটি বৈশ্বিক। আর এ কারণে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ৭৫ বছর আগে আমলে নেওয়া হয়েছে। ব্রাসেলসে আমাদের আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। প্রায় ১০০টি দেশে আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে বিশ্বের সব দেশে কার্যালয় স্থাপন করা যায়নি। আর এ কারণে যেখানে প্রয়োজন, সেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কার্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। বাংলাদেশ সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এ পরিবর্তন সহজ নয়। এখন যেখান থেকেই সম্ভব, সেখান থেকেই বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর আমরাও সে প্রস্তাব দিয়েছি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের (আইসিটি) ন্যায়বিচার হওয়া নিয়ে কোনো উদ্বেগ রয়েছে কিনা? তিনি বলেন, আপনি যদি আইসিটি আইনটির দিকে মানবাধিকার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন, তাহলে বুঝবেন এখানে আন্তর্জাতিক মানের ঘাটতি রয়েছে, সুষ্ঠু বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তার জন্য এগুলো আমলে নেওয়া প্রয়োজন। এ আইনের সংস্কার প্রয়োজন। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি।
নির্বিচারে মামলা করা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান বলেন, এটি আমলে নেওয়া হয়েছে। এমন মামলা করা উচিত নয়, যা ঘটেনি। এর জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। এখানে অতীতের মতো ভুল করা যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করতে হবে, যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আপনার কেমন আস্থা রয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, সফরে আমি বেশ কিছু অসাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করেছি। তাদের সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাসের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এটাও মনে রাখতে হবে যে পরিবর্তন অনেক সময় ভঙ্গুর হয়। ফলে পরিবর্তনের সব জায়গা থেকে সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ সরকারের দেশের মানুষের ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এ সহযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য আমি সবাইকে আহ্বান জানাই। আমার আসার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি সংহতি জানানো ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
ডিসেম্বরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক গতকাল তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের কাজ এবং ঢাকায় সফরকালীন সরকারের উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান, সংস্কার কমিশনের প্রধান, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক সম্পর্কে অবহিত করেন। গত জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত নৃশংসতার ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের কাজ চলমান আছে বলে প্রধান উপদেষ্টাকে জানান। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
হাইকমিশনার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, যা বিপ্লবের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করছে, তার কাজ নিয়েও আলোচনা করেন। পাশাপাশি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংস্কার কমিশন নিয়েও আলোচনা করেন তিনি।
স্বৈরাচারী সরকারের সময় ঘটে যাওয়া বলপূর্বক গুমের অনেক ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানান ভলকার তুর্ক। তিনি বলেন, এমন অনেক কিছু আছে যা ঠিক করা দরকার। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে স্বাধীন এবং সম্পূর্ণ কার্যকরী করে শক্তিশালী করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ভলকার তুর্ককে বাংলাদেশ সফর করার জন্য এবং বিপ্লবের সময় তাঁর সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি বলেন, তাঁর সরকার প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এবং উন্নয়ন ও মানবাধিকার যেন একসঙ্গে চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর সরকার আগের সরকারের ভুল ও অপরাধের পুনরাবৃত্তি করবে না বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার এবং প্রধান উপদেষ্টা এ সময় রোহিঙ্গা সংকট, বিশেষ করে মিয়ানমারে সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার নতুন রোহিঙ্গার আগমন নিয়েও আলোচনা করেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আরও আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং সংকট সমাধানে অব্যাহত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন ভলকার তুর্ক। প্রধান উপদেষ্টা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করতে জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছেন, যাতে এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত লোকরা তাদের নিজ অঞ্চলের কাছাকাছি থাকতে পারে।
জাতিসংঘের অফিস খোলার বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর চালুর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন। এর আগে সকালে নিজের দপ্তরে তিনি ভলকার তুর্কের সঙ্গে বৈঠক করেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অফিস দেওয়া নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দেওয়া হবে না, এটাও বলা হয়নি। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রস্তাব আছে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিতভাবে কোনো প্রস্তাব দেয়নি, কথাবার্তা হচ্ছে।
এই দপ্তর খুলতে দিলে সমস্যা কী– জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, এটা এভাবে না বলে বলতে পারি, আমরা দেখি যে আমাদের প্রয়োজন আছে কিনা।
আহতদের পাশে ভলকার তুর্ক
গতকাল সকালে আগারগাঁও জাতীয় অর্থোপেডিকস হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান নিটোরে যান ভলকার তুর্ক। এই হাসপাতালে বর্তমানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ৫৭ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। এ সময় আহতদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকে জানতে চান, কাদের গুলিতে আহত হয়েছে আন্দোলনকারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিটোরের এক যুগ্ম পরিচালক বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার নিটোরে আসবেন এমন কোনো আমাদের কাছে ছিল না। তিনি সরাসরি হাসপাতালে এসে আন্দোলনে আহতদের দেখতে চলে যান।
Posted ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
nykagoj.com | Stuff Reporter